পাঠক কলাম

মাদকসন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে সরকারকেই জোরালো ভূমিকা নিতে হবে : মো. আলীআশরাফ খান

লেখার শিরোনাম দেখে হয়তো অনেকেই ভাবতে পারেন, কেনো লেখাটির এমন শিরোনাম দেয়া হলো। আসলে আমি মাদক ব্যবসায়ীদেরকে শুধু সন্ত্রাসীই মনে করি না-আমি মনে করি, মাদকব্যবসায়ীরা এমন একটি সর্বনাশাগোষ্ঠী যা পারমাণবিক বোমার চেয়ে ভয়ঙ্কর এবং তারা এমন এক ভয়াবহ ক্ষতি সাধন করছে দেশ-জাতির যা যে কোন সন্ত্রাসের চেয়ে শতগুনে ভয়ঙ্কর। এই মাদকসন্ত্রাসীরা জাতির মেধা ও সৃজনীশক্তিকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। একটি দেশ ও জাতিকে ধ্বংস করার জন্য যেসব অস্ত্র আবিষ্কার হয়েছে এর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ভয়াবহ অস্ত্র হলো মাদক। একবার ঢুকে গেলে এই মাদকসন্ত্রাসের হাত থেকে কোনভাবেই রক্ষা পাবার উপায় নেই-যতক্ষণ না ফেরানো যায় আসক্তির এই পঙ্কিলতার পথ থেকে। তাছাড়া মাদক নিয়ে আমরা ইতোঃপূর্বে বহু লেখালেখি করেছি বিভিন্ন শিরোনামে। যার করানে এই শিরোনামটি-ই আমাকে বেছে নিত হলো। আশা করি, সরকার এবার  এই শিরোনামটির প্রতি গুরুত্ব দেবে।
দিন যতই অতিবাহিত হচ্ছে ততই যেন আমাদের তরুণরা ভয়াবহ এক অন্ধকারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। মাদকের নীল বিষের ভয়াবহতায় মজে যাচ্ছে আমাদের প্রিয় তরুণ সমাজ। কোন কথাই তাদেরকে শোনানো যাচ্ছে না এখন। একরোখা হযে মাদকের প্রতি বুঁকে পড়ছে আমাদের ছেলেমেয়েরা। তাদের মেধা-মনন ও সৃজনীশক্তি অঙ্কুরেই বিনাশ হয়ে যাচ্ছে মাদক গ্রহণের ফলে। কিন্তু এই ভয়াবহ মাদকের পথ থেকে তরুণদের ফিরিয়ে আনতে তেমন কোন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেই আমাদের। বরং আমরা যেন ভয়ঙ্কর একটি সময়ের জন্য অপেক্ষা করছি। আর তাকিয়ে তাকিয়ে ভয়াবহ মাদকবাণিজ্যের প্রসার ও  মাদকসেবীদের কা-কারখানা দেখছি। যা একটি জাতির জন্য চরম অমঙ্গলের; যা একটি জাতিকে ধ্বংসের ধারপ্রান্তে পৌঁছে দেয়ার জন্যই যথেষ্ট; যা একটি জাতির সামগ্রিক উন্নতির পথকে রুদ্ধ করার জন্য মহাপ্রাচীরের মত।
আজকাল আমরা অনেকেই বড় বড় কথা বলি, আসলে কাজের ক্ষেত্রে ফাঁকাবুলি ছাড়া আমাদের তেমন কিছু যে নেই-এটা এখন দিনের আলোর মতই পরিষ্কার। কেউ স্বীকার করুক আর না করুক, এটাই বাস্তব-চিরন্তন সত্য। আর এই সত্য কথাটি আমাদের মেনে নিতেই হবে। মাদকের নীল ছোবলে আমাদের ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ যে অন্ধকার পতিত-এটা কি কেউ অস্বীকার করতে পারবে? দেশের সচেতন মানুষজন কি কখনো চাইবে মাদকের অন্ধকারে তলিয়ে যাক তরুণ সমাজ? নিশ্চয়ই নয়। এই মাদকসন্ত্রাসের ফলে আমাদের সমাজ ভেঙে পড়ুক; চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই, খুনখারাবি, ধর্ষণ, ইভটিজিংসহ নানা অপরাধ কর্মকা- একের পর এক ঘটতে থাকুক; সমাজে এটা কারো কাম্য হতে পারে না।। কোন সচেতন মানুষ মেনে নিতে পারে না-এই মাদক নেশার ভয়াবহ মরণ কামড়ে মা-বাবাকে তার সন্তান নির্মমভাবে খুন হোক; খুন হোক মাদকসেবীদের দ্বারা তার প্রিয় স্ত্রী-সন্তানসহ প্রতিবেশিরা। অথচ, এমনটাই চলছে অহরহ আমাদের দেশে। মাদকের নীল বিষের ভয়াবহ অথৈ জলে ভাসছে দেশ।
অপ্রিয় হলেও সত্য, একশ্রেণির পথভ্রষ্ট রাঘববোয়ালদের দাপটে এখন সৃষ্টিশীল মানুষজন কোন অপরাধ কর্মকা-ের-ই প্রতিবাদ করার সাহস পাচ্ছে না। যার ফলশ্রুতিতে দেশে যাচ্ছেতাইভাবে মাদকবাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে কিছু অসৎ ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান। অবাক করা বিষয়! প্রশাসনের সহযোগিতাই চলছে এসব মাদকের মহাবাণিজ্য! মাদকসন্ত্রাসীদের এখন এমনও বলতে শোনা যায়, ‘পুলিশ কার? পুলিশ আমাদের। আমরা যা চাই, তাই হয়-তাই হবে’। মাদকবিক্রেতারা আরো দম্ভ করে বলে থাকেন, ‘আমরা পুলিশ পকেটে রাখি। পুলিশ আমাদের কিছুই করতে পারবে না। এসপি, এএসপি, ওসি, এসআই ও এএসআইসহ প্রশাসনের সবাই আমাদের টাকায় চলে। তাদেরকে আমরা ভয় করি না। আমরা মাসিক হারে টাকা না দিলে তাদের চুলায় বিলাই ঘুমায়।’ মাদকসন্ত্রাসীদের এসব কথাবার্তা শুনলে যে কারো গায়ে আগুন লেগে যাওয়ার কথা। কিন্তু সাধারণ মানুষ অসহায়। সাধারণ মানুষের পক্ষে কিছু করার নেই-এসব মাদক সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে। যেখানে স্বয়ং প্রশাসন জড়িত বলে প্রতিয়মান সেখানে সাধারণ মানুষ কি প্রতিবাদ করে জেলের ভাত খাবে?
আমি দাউদকান্দি উপজেলার গৌরীপুরে বাস করি। এখানে মাদক বিক্রি-সেবন যেন খোলাবাজারের নিত্যনৈমিত্তিক পণ্যের মত কেনাকাটর বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখানে মাদকদ্রব্য সহজলভ্য হওয়ায় ছোট ছোট ছেলেমেয়েদেরও মাদকসেবন মামুলি ব্যাপার। যে কেউ, যে কোন সময়, যে কোন ধরনের মাদক কিনতে পারে এখানে। ইয়াবা থেকে শুরু করে সব ধরনের মাদক পাওয়া যায় গৌরীপুর বাজারে। ইউনিয়ন পরিষদের সামনে, দক্ষিণ বাজার বালুর মাঠ, মাইথারকান্দি মসজিদের ভেতর দিয়ে গিয়ে পূর্ব পাড়ে, গৌরীপুর হাইস্কুল সংলগ্ন ব্রিজের পার্শ্বে, পশ্চিম বাজার বালুর মাঠ, উত্তর বাজার কাঠপট্টি, অবদা অফিসের পার্শ্বে, পশ্চিম বাজার ঈদগাহর পাশে ও বালুর মাঠে মাদকবিক্রেতারা দাঁড়িয়ে দিব্বি মাদক বেচা-কেনা করতে দেখা যায় দিনদুপুরে। মাঝে মধ্যে ছোট্ট ছ্টো ছেলেমেয়েদেরকেও বাহক হিসেবে ব্যবহার করছে এসব মাদকবিক্রেতা ও সেবনকারীরা।
এমনি করে গৌরীপুর বাজারের আনাচেকানাচে মাদক বিক্রি ও সেবন চলছে দেদারছে। বেশির ভাগ স্কুলের শিক্ষার্থী ও উদীয়মান তরুণরাই এসব মাদক সেবন করছে। কিন্তু কেউ নেই দেখার, কেউ নেই কিছু বলার, কেউ নেই এই মাদকের ভয়াল পথ থেকে আমাদের সন্তানদের ফেরাবার। অভিভাবকরা এখন দিশেহারা। কোনভাবেই পারছে না রুখতে তাদের ভবিষ্যতের স্বপ্ন-সন্তানদের। অনেক স্কুল-কলেজ শিক্ষার্থী তাদের পড়াশোনা ফাঁকি দিয়ে মাদকের নেশায় বুঁদ হয়ে বিভিন্ন নির্মাণাধীন ও পরিত্যাক্ত ভবনসহ সরু অলিগলিতে পড়ে থাকতে দেখা যায়। মাদক বিক্রেতাদের সঙ্গে পুলিশের শখ্যতা তথা যোগসাজশের কারনে মানুষ কিছু বলতে ভয় পায়। এককথায, মাদকসন্ত্রাসের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে মানুষ। তাছাড়া মাদকসন্ত্রাসীরা নিজেদের এতটাই ক্ষমতাবান মনে করে, ভাবেসাবে মনে হয়, তারা সব আইন-কানুনের ঊর্ধ্বে। তারা যেন সমাজের নেতা। তারাই সমাজ পরিচলনা করেন! আর হবে না বা কেনো, মাদক ব্যবসায়ীরা কোন কারনে প্রশাসনকে ফোন দিলে পুলিশ প্রশাসন দ্রুত পৌঁছে যায় অপরাধীদের অপরাধ কর্মকা- ঢাকতে। আর সাধারণ মানুষ পুলিশ-প্রশাসনকে কোন প্রয়োজনে ফোন দিলে অনেক সময় তারা ফোন ধরেন না এবং কোন কোন সময় ফোন ধরলেও ঘটনা ঘটার ১ঘন্টা পরে ঘটনাস্থলে পৌঁছতে দেখা যায় তাদেরকে।
ভাবতে অবাক লাগে, মাদকসন্ত্রাসীদের অপকর্মের সংবাদ পত্র-পত্রিকায় প্রচার হলেও তাদের কিছু যায় আসে না। কারণ, পুলিশ-প্রশাসন তাদের হাতে। যদিও কোন কোন সময় জেল-হাজতে তাদেরকে যেতে হয়। কিন্তু অল্প কয়েক দিন পরেই জামাই আদর পেয়ে ওরা বেরিয়ে আসে এবং বীরদর্পে শুরু করে পুরনো ব্যবসা। আমরা পত্র-পত্রিকা ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া থেকে জানতে পারি, কোটি কোটি টাকা মূল্যের ইয়াবাসহ নানা ধরনের মাদকসহ গ্রেপ্তার হন পুলিশ ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা। রাজধানীসহ দেশের প্রায় সব জায়গায় মাদক ব্যবসায়ীদের বড় সিন্ডিকেটের খবর থাকে পুলিশের কাছে। কিন্তু পুলিশ প্রশাসনকে নিরব ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়! শুধু কি তাই, এই মাদকের অনৈতিক ব্যবসায় জড়িয়ে পুলিশ প্রশাসন এখন আঙ্গুলফুলে কলাগাছে পরিণত হযেগেছেন, হচ্ছেন। কিন্তু সরকারের কোন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা আমরা দেখছি না। আমাদের সন্তানদের নিয়ে তাদের ভাবনার কোন প্রয়োজন আদৌ আছে কি? তরুণদের ভবিষ্যৎ কতটা গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত হচ্ছে-এটা ভাবার অবকাশ তাদের নেই। ওইসব মাদকসন্ত্রাসীরা একবারও চিন্তা করে না, তাদের সন্তানরাও যদি মাদকের মরণ নেশায় আসক্ত হয়ে চিরতরে পরপারে চলে যায় তখন তাদের কেমন লাগবে।
পরিশেষে আমরা একটা কথাই বলতে চাই, সরকার যদি মনে করে জাতিকে বাঁচাতে হবে, বাঁচাতে হবে এদেশের তরুণ সমাজকে, রক্ষা করতে হবে আমাদের স্কুল-কলেজ পড়–য়া কোমলমতি শিক্ষার্থীদের। তাহলে অটোরিকসা সিএনজির মত জরুরিভিত্তিতে মাদকসন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সরকারকেই জোরালো ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে। আমরা মনে করি, সরকার আন্তরিক হলে এই দেশ থেকে মাদক নির্মূল অর্থাৎ চিরতরে বিদায় করা সময়ের ব্যাপার মাত্র। পাশাপাশি মাদকসন্ত্রাসের বিরুদ্ধে দেশের সকল সচেতন মানুষদেরকেও এগিয়ে আসতে হবে, সংগঠন বদ্ধ হয়ে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে এই ভয়াবহ মাদকসন্ত্রাসকে নির্মূল করার লক্ষে। এর কোন বিকল্প আছে বলে আমরা মনে করি না। এটাই আমাদের শেষ কথা।
লেখক: মো. আলী আশরাফ খান
কবি, কলামিস্ট, প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি ‘সৃষ্টি’
ই-মেইল: [email protected]

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button