ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষন তারুণ্য ভাবনায় এগিয়ে চলার প্রত্যয়

আবুল বাশার শেখ
আজ ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা অবিস্মরণীয় একটি দিন। ইতিহাসের পাতা থেকে এ দিনটি নিয়ে দু’কলম লেখার দুঃসাহস করলাম, কেননা আমার জন্ম ঐ সময় হয়নি। দিনটি ছিল বসন্তের এক পাতাঝরা শুকনো টান টান দিন। কিন্তু আর দশটি দিনের চেয়ে আলাদা ছিল একাত্তরের ৭ই মার্চ, একটু ভিন্ন রকম। একজন তরুন নেতা দিনে দিনে নিজেকে চালকের আসনে এনে একটি আন্দোলনকে জনগণের প্রাণের দাবিতে পরিণত করলেন। একটি ভাষণ একটি জাতিকে স্বাধীনতার মন্ত্রে যেভাবে উজ্জীবিত করেছিল, তার তুলনা আর কোনো কিছুর সঙ্গে হতে পারে না। ১৯৭১ সালের এই দিনে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক উত্তাল জনসমুদ্রে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন। “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম” বঙ্গবন্ধুর এই তেজোদীপ্ত ঘোষণাই ছিলো বাংলাদেশের জন্ম বৃত্তান্তের প্রথম ভিত্তি। পশ্চিম পাকিস্তানি সৈরশাসকদের অত্যাচার নিপীড়ন উপেক্ষা করে বীর বাঙালি অস্ত্র ধারণের পূর্বে বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে ঐ দিনই স্বাধীনতার ডাক দেয়া হয়েছিলো। কারণ এর পর আর বঙ্গবন্ধু সাধারণ মানুষের মধ্যে কথা বলার সুযোগ পাননি। সেদিন উত্তাল জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে বাংলার মুক্তিকামী জনতার উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন- তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে……..।’
বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক রেসকোর্সে এ ভাষণ যখন দিচ্ছিলেন ঠিক ওইদিনই ঢাকায় এসে পৌঁছান জেনারেল টিক্কা খান ও রাও ফরমান আলী। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর আলোচনার অন্তরালে সামরিক প্রস্তুতির এক পর্যায়ই বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে ত্বরান্বিত করে। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক সেই ভাষণ এ দেশের জনগণকে দারুণভাবে আন্দোলিত করে। ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’ শ্লোগানে স্বাধীনতার জন্য উন্মুখ জাতি বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়েছিলেন। এই একটি ভাষণেই নিরস্ত্র বাঙালিকে সশস্ত্র জাতিতে পরিণত করে।
৭ই মার্চের বক্তৃতার ভেতর দিয়ে ফুটে ওঠে এক সিদ্ধান্তে অটল এক রাজনৈতিক নেতার পরিচয়। কেননা তিনি স্পষ্ট করেই বলেছিলেন, “শহীদের রক্তের ওপর দিয়ে, পাড়া দিয়ে আরটিসিতে মুজিবুর রহমান যোগদান করতে পারে না। অ্যাসেম্বলি কল করেছেন, আমার দাবি মানতে হবে প্রথম। সামরিক আইন মার্শাল ল উইথড্র করতে হবে। …আমি, আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না। আমরা এ দেশের মানুষের অধিকার চাই।” সেই অধিকার তিনি এনে দিয়েছিলেন বাংলাদেশের মানুষকে।
বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণকে বিশ্বের বিখ্যাত ভাষণগুলোর পাশাপাশি তুলনা করা হয়েছে গ্যাটিসবার্গ অ্যাড্রেসের সঙ্গে। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ দীর্ঘদিনের শোষণ, বঞ্চনার বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিল একটি কণ্ঠ। অন্যায়, অগণতান্ত্রিক আচরণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে জাতিকে পরিপূর্ণভাবে জাগিয়ে তুলেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐ ভাষণ। তাই বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ আমাদের প্রেরণার চিরন্তন উৎস হয়ে থাকবে। তারুণ্য দীপ্ত জ্বালাময়ী মুক্তিকামী সেই ভাষণ আজও সারা বাংলাদেশে ৭মার্চের সকাল থেকে সন্ধ্যাবদী মাইকে বাজতে থাকে। এই ভাষণটি যখন বাজে তখন মনে হয় বঙ্গবন্ধু বর্তমান।
ইতিহাস থেকে জানা আজ থেকে ৪৫ বছর আগের কথা। ১৯৭০-এ ঐতিহাসিক নির্বাচনে বাংলার মানুষের ভোটে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি করতে থাকে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে আলোচনার আড়ালে সামরিক অভিযানের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে পাকিস্তানের সামরিক জান্তারা। নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের পরও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ক্ষমতা হস্তান্তরে অনীহার কারণে বাংলার মুক্তিকামী মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং সামরিক বাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেয়ার দাবিতে ৬ মার্চ পর্যন্ত ঘোষিত হরতাল, অসহযোগ আন্দোলন চলে। ৩রা মার্চ অনুষ্ঠিত পল্টনের জনসমাবেশে আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ৬ মার্চের মধ্যে যদি সরকার তার অবস্থান পরিবর্তন না করে তাহলে ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় আন্দোলনের পূর্ণাঙ্গ কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। তাই ৭ মার্চ সকাল থেকেই চারদিক থেকে মানুষের ঢল নামে রেসকোর্স ময়দানে। ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা তোমার আমার ঠিকানা’ ‘তোমার দেশ আমার দেশ বাংলাদেশ বাংলাদেশ’, শ্লোগানে শ্লোগানে মুখরিত হতে থাকে রেসকোর্স ময়দান। জনসমুদ্রে পরিণত হয় রেসকোর্স ময়দান।
বঙ্গবন্ধু জনসভায় আসতে একটু বিলম্ব করেন। স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়া হবে কি হবে না এ নিয়ে তখনো রুদ্ধদ্বার বৈঠক চলছে নেতৃবৃন্দের মধ্যে। বেলা ঠিক সোয়া ৩টায় সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি আর মুজিব কোট পরিহিত বঙ্গবন্ধু যখন মঞ্চে ওঠেন তখন বাংলার বীর জনতা করতালি ও শ্লোগানের মাধ্যমে তাকে অভিনন্দন জানান। এরপর বঙ্গবন্ধু দীর্ঘ ২২ মিনিট তার জীবনের শ্রেষ্ঠ ও ঐতিহাসিক ভাষণ শুরু করেন।
বঙ্গবন্ধুর ভাষণের আগে আসম আব্দুর রব, নূরে আলম সিদ্দিকী, শাহজাহান সিরাজ, আব্দুল কুদ্দুস মাখন, আব্দুর রাজ্জাক প্রমুখ নেতৃবৃন্দ মঞ্চ থেকে মাইকে নানা ধরনের শ্লোগান দিয়ে উপস্থিত জনতাকে উজ্জীবিত রাখেন।
বঙ্গবন্ধু আমাদের যে শিক্ষা দিয়ে গেছেন এই ঐতিহাসিক ৭ মার্চের মাধ্যমে তা ভুলার নয়। এই দিনের শিক্ষা নিয়ে আমাদের বর্তমান তরুণ প্রজন্মকে এগিয়ে যেতে হবে সামনের দিকে। শুধুমাত্র এই দিনটি আসলেই এই ভাষণ শুনতে হবে তা নয় এই ভাষণটি সব সময় শুনতে হবে সে সাথে বিচার বিশ্লেষণ করতে হবে কি ছিল ঐ ভাষণের মূলমন্ত্র। একটি ভাষণ দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ তার জলন্ত প্রমাণ এই ৭মার্চের ভাষণ। এই ভাষণটি নিয়ে সারা বিশ্বে কম আলোচনা-সমালোচনা হয়নি, এতে করে এর গুরুত্ব ফুটে উঠেছে। নানা গবেষণার পর বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ বিশ্বের অন্যতম সেরা ভাষণ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এটা বাঙালি জাতি তথা বাংলাদেশের সকল মানুষের জন্য পরম পাওয়া। এর গরুত্ব তরুন প্রজন্মকে অনুধাবন করতে হবে সে সাথে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। তবেই এই ভাষণ পূর্ণতা পাবে।