চেতনায় কবি নজরুল-সফিউল্লাহ আনসারী

বিদ্রোহ,প্রেম,বিরহ ও সাম্যবাদী কবি নজরুল(২৫মে,১৮৯৯—২৯আগস্ট,১৯৭৬)।
যার পরিচয় তাঁর লেখাতেই স্পষ্ট।কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের জাতীয় কবি।কাজী নজরুল আমাদের আদর্শ-চেতনার কবি।যার ক্ষুরধার লেখনিতে জাগরণ আসে।প্রেমের অমর সুধায় আপ্লুত হওয়া যায়,ধমীর্য় বিভেদ ভুলে অসাম্প্রদায়ীক হওয়া যায়।ধমীর্য় মুল্যবোধে জাগ্রত হওয়া যায়।তিনি আমাদের জাতীয় চেতনার প্রতীক এবং দারিদ্রকে স্যালুট করার সাহসিকতাকে বোধের চুড়ায় স্থাপিত করার নায়ক।নজরুলের আদর্শকে ধারন করে আমরা বাঙালী ও বাংলাদেশীরা অসম্প্রদায়িক চেতনায় দেশ প্রেমে উদ্ভুদ্ধ হয়ে বিশ্বের মাঝে অনন্য জাতী হিসেবে নাম করতে পারি।কবি কাজী নজরুল ইসলামকে শুধু কবি বা লেখক নামে আবদ্ধ করা যায়না কারন তিনি ছিলেন,একাধারে-কবি,উপন্যাসিক,গীতিকার,সুরকার,নাট্যকার,কবি,উপন্যাসিক,গীতিকার,সুরকার,নাট্যকার(উইকিপিডিয়া),সাংবাদিক,গায়ক-নায়ক,দার্শনিক ও রাজনীতিক।যেবিষেশনেই বা যে দিক থেকেই দেখিনা কেনো সেখানেই তার স্বপ্রতিভ উপস্থিতি ও বলিষ্ট অবস্থান দেখতে পাই।দুই বাংলাতেই (পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ)তাঁর কবিতা ও গান সকলের কাছেই সমানভাবে সমাদৃত।নারী-পুরুষের মাঝে বিভেদ ভাঙলেন কবি এভাবেই-
বিশ্বে যা-কিছু মহান্ সৃষ্টি চির-কল্যাণকর,/অর্ধেক তার করিয়াছে নারী,অর্ধেক তার নর।/বিশ্বে যা-কিছু এল পাপ-তাপ বেদনা অশ্রুবারি,/অর্ধেক তার আনিয়াছে নর,অর্ধেক তার নারী।/নরককুন্ড বলিয়া কে তোমা’করে নারী হেয়-জ্ঞান?/তারে বলো, আদি পাপ নারী নহে,সে যে নর-শয়তান।/অথবা পাপ যে-শয়তান যে-নর নহে নারী নহে,/ক্লীব সে, তাই সে নর ও নারীতে সমান মিশিয়া রহে।/এ-বিশ্বে যত ফুটিয়াছে ফুল, ফলিয়াছে যত ফল,/নারী দিল তাহে রূপ-রস-মধু-গন্ধ সুনির্মল।/তাজমহলের পাথর দেখেছ, দেখিয়াছে তার প্রাণ,/অন্তরে তার মোমতাজ নারী, বাহিরেতে শা-জাহান।/জ্ঞানের লক্ষ্মী, গানের লক্ষ্মী, শস্য লক্ষ্মী নারী,/সুষমা-লক্ষ্মী নারীই ফিরিছে রূপে রূপে সঞ্চারি’।(…)
অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে,স্বৈর শাসকের বিরুদ্ধে তার অপ্রতিরুদ্ধ ও দু:সাহসি রচনা ও অবস্থান তাকে বিদ্রোহী কবি হিসেবে পরিচিতি দিয়েছে। তার রচিত অনন্য রচনা বিদ্রোহী (১৯২২) কবিতা যা পরাধীনতার শৃংখল থেকে বাঙালী জাতিকে মুক্তির পথে উজ্জীবিত করেছে।মানুষ জেগেছে নতুন করে তার এই কবিতার শক্তিতে।অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে নজরুল সর্বদাই ছিলেন সোচ্চার কবি নজরুল জেল-জুলুম সহ্য করেছেন কিন্ত অন্যায়ে কাছে কখনো মাথা নত করেন নি।তাঁর লেখনিতেই তা স্পষ্ট-
“তোরা সব জয়ধ্বনি কর্! তোরা সব জয়ধ্বনি কর্!!/ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কাল্-বোশেখির ঝড়।/তোরা সব জয়ধ্বনি কর্! তোরা সব জয়ধ্বনি কর্!!/আস্ছে এবার অনাগত প্রলয়-নেশার নৃত্য-পাগল,/সিন্ধু-পারের সিংহ-দ্বারে ধমক হেনে ভাঙ্ল আগল।/মৃত্যু-গহন অন্ধ-কূপে মহাকালের চণ্ড-রূপে–
ধূম্র-ধূপে বজ্র-শিখার মশাল জ্বেলে আস্ছে ভয়ঙ্কর–/ওরে ঐ হাস্ছে ভয়ঙ্কর! তোরা সব জয়ধ্বনি কর্!”(প্রলয়োল্লাস/কাজী নজরুল ইসলাম)
নজরুলের রচনায় ছিলো-বাংলা ছাড়াও আরবী,ফারসি,হিন্দী,ইংরেজীসহ একাধীক ভাষায় ব্যাবহার।একাডেমিক শিক্ষায় তার সনদ না থাকলেও কবির রচনা স্কুল-কলেজ ও ভার্সিটিতে সিলেবাস আকারে পড়ানো হয়।এটা কতটা বড় মাপের ও গর্বের তা বলার অপেক্ষা রাখেনা।কবি নজরুল ইসলাম প্রায় ৩০০০ জনপ্রিয় গান রচনা ও গানের সুর করেছেন যেগুলো ‘নজরুল সংগীত/নজরুল গীতি’ নামে পরিচিত ।
এই মহান কলম সৈনিক-‘১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২৫ মে, ১১ জৈষ্ঠ্য ১৩০৬ বঙ্গাব্দ,পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।’‘কাজী ফকির আহমেদের দ্বিতীয় স্ত্রী জাহেদা খাতুনের ষষ্ঠ সন্তান তিনি। তাঁর বাবা ফকির আহমদ ছিলেন স্থানীয় মসজিদের ইমাম এবং মাজারের খাদেম। নজরুলের তিন ভাইয়ের মধ্যে কনিষ্ঠ কাজী আলী হোসেন এবং দুই বোনের মধ্যে সবার বড় কাজী সাহেবজান ও কনিষ্ঠ উন্মে কুলসুম। কাজী নজরুল ইসলামের ডাক নাম ছিল ‘দু:খু মিয়া’।ছাত্রজীবনে নজরুলের প্রথম স্কুল ছিল রানীগঞ্জের সিয়ারসোল রাজ স্কুল, এরপর ভর্তি হন মাথরুন উচ্চ ইংরেজি স্কুলে যা পরবর্তীতে নবীনচন্দ্র ইনস্টিটিউশন নামে পরিচিতি লাভ করে।’
‘১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ১২ আগস্ট নজরুল ধূমকেতু পত্রিকা প্রকাশ করেন। এটি সপ্তাহে দু’বার প্রকাশিত হতো।১৯২০-এর দশকে অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলন এক সময় ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এর পরপর স্বরাজ গঠনে যে সশস্ত্র বিপ্লববাদের আবির্ভাব ঘটে তাতে ধূমকেতু পত্রিকার বিশেষ অবদান ছিল।’কাজী নজরুল ইসলামের প্রাপ্ত পুরস্কারের মধ্যে-স্বাধীনতা পুরস্কার (১৯৭৭),একুশে পদক (১৯৭৬),পদ্মভূষণ উল্লেখযোগ্য।“১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দের ২৯ আগস্ট তারিখে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। নজরুল তার একটি গানে লিখেছেন, “মসজিদেরই কাছে আমায় কবর দিয়ো ভাই/যেন গোরের থেকে মুয়াজ্জিনের আযান শুনতে পাই”;-কবির এই ইচ্ছার বিষয়টি বিবেচনা করে কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে সমাধিস্থ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এবং সে অনুযায়ী তাঁর সমাধি রচিত হয়।”(উইকিপিডিয়া)
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে কাজি নজরুল ইসলামের নাম স্বার্ণাক্ষরে লেখা থাকবে অনন্তকাল।তার রচিত অসংখ্য গ্রন্থ আমাদের সম্পদ।অসাম্প্রদায়ীক এই কবি ইসলামী সংগীত রচনার পাশাপশি অনেক শ্যামা সংগীতও রচনা করেন । তাঁর সাহিত্যকর্মে সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা ছিল সুস্পষ্ট,মানবতাবাদ ছিলো প্রবল।মানবতাবাদী এই মহান কবি ছোট-বড় সকলের জন্যই লিখেছেন।ছোটদের জন্য কবির জনপ্রিয় লেখা-
থাকবোনাকো বদ্ধ ঘরে
দেখবো এবার জগৎটাকে
কেমন করে ঘুরছে মানুষ
যুগান্তরের ঘূণির্পাকে।
(…)
পাতাল ফেরে নামব আমি
উঠব আমি আকাশ ফুঁড়ে,
বিশ্বটাকে দেখব আমি
আপন হাতের মুঠোয় পুরে।
–এর মতো অসংখ্য লেখা শিশু সাহিত্যকে করেছে সমৃদ্ধ।
নজরুল আমাদের চেতনায়,আর নজরুলের চেতনায় আমাদের অসাম্প্রদায়ীক স্বপ্নের দেশ।নজরুলে অহিংস চেতনাকে লালন করে,ধারন করে এবং প্রতিটা কর্মে বাস্তবায়ন করে আমরা কবিকে অমর করতে পারি।কবি নজরুল-গরীবের কবি,মানুষের কবি,বড়দের কবি,ছোটদের কবি,নির্যাতিদের কবি, সত্য-ন্যায়ের কবি,সর্বোপরি গণমানুষের কবি।বাংলা-বাঙালীর মননে কাজী নজরুল ইসলামের মর্যাদা ও গুরুত্ব ছিলো,আছে,থাকবে ।‘মধ্যবয়সে তিনি পিকস ডিজিজে আক্রান্ত হন। এর ফলে দীর্ঘদিন তাকে সাহিত্যকর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে হয়। একই সাথে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন এবং ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট মৃত্যূবরণ করেন।’(সংগৃহীত)। সংক্ষিপ্ত আলোচনায় মহান কবির জীবন-কর্ম লেখা যায়না-যাবেনা…!তাঁর কবিতার দু‘টি লাইন দিয়ে শেষ করতে চাই…
“নর বাহে হল,নারী বহে জল,সেই জল-মাটি মিশে’/ফসল হইয়া ফলিয়া উঠিল সোনালী ধানের শীষে।”
কবিও আমাদের হৃদয়ে ভালোবাসা আর অকৃত্রিম উচ্ছাসে আছেন মিশে।এই প্রত্যাশায় কবির প্রতি গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।