কোয়ান্টাম বদলে দিচ্ছে জীবন, বদলে দিচ্ছে জাতি

শাকিলা নাছরিন পাপিয়া
আমরা যখন শিশু-কিশোর ছিলাম তখন আমাদের স্বপ্নের জগৎ তৈরি হতো বইয়ের পাতায়। ‘আমাদের ছোট নদী’, ‘নিমন্ত্রণ’ অথবা ‘মাঝি’ কবিতা যখন পড়তাম নিজেকে বিষয়বস্তুর সঙ্গে এক করে কল্পনার আকাশে ডানা মেলে দিতাম। ১৫-১৬ বছর বয়সে পড়েছিলাম ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায় রচিত ‘শাপমোচন’ বইটি। মাধুরীর জীবনের শেষ পরিণতি আলোড়িত করেছিল। ভালোবাসার মানুষকে নিয়ে সংসার বাঁধার স্বপ্ন দেখেনি সে। হাঁস, মুরগি, গরু, ছাগলের খামার, বাগানের ফল, দুস্থদের সেবা, বিশাল প্রজেক্টে হাজারো বেকারের কর্মসংস্থান, নায়কের মুখে শোনা তার ভাইপোর দুধ খেতে না পারার দরিদ্রতার গল্প মনে রেখে সপ্তাহে এক দিন দরিদ্র শিশুদের পুষ্টির জন্য দুধ ও ডিম বিতরণ_ এসব কর্মকা- ওই বয়সে অন্যরকম এক জীবনের স্বপ্ন দেখতে অনুপ্রেরণা দিয়েছিল। পরবর্তীতে স্বপ্ন থাকলেও তার পথ ধরে হাঁটা হয়নি। সংসার, স্বার্থপরতা আর বস্তুবাদী জীবনের নাগপাশে বাঁধা পরা জীবনের ছক ভাঙার সাহস খুঁজে পাইনি। জীবনের এই মধ্যাহ্ন অথবা শেষ প্রান্তে এসেও যখন জোছনার অপার্থিব আলোয় প্লাবিত হয় ধরণী অথবা ক্লান্ত কোনো দুপুরে অবসর আর অবসন্নতার মাঝে দূরে শোনা যায় ঘুঘুর ডাক তখন জীবনের হিসাবের খাতায় পিছু ফিরে দেখি নিজের স্বপ্নটাকে। সে স্বপ্ন ছোঁয়া হয়নি এ জীবনে। কোয়ান্টামের নাম শুনেছিলাম অনেক আগেই। তাদের কর্মকা-ের সঙ্গে পরিচিত ছিলাম না। হঠাৎ আমার সহকর্মী রোমেনা আফরোজ রুমা চার দিনের একটা কোর্স করে এলেন কোয়ান্টাম থেকে। দেখলাম ওর মধ্যে আচমকা অনেক পরিবর্তন। গত ১০-১২ বছরে যে একটিও রোজা রাখতে পারেনি সে গত বছর একটিও রোজা ভাঙেনি। কোরআন খতম করেছে। সর্বোপরি নানা ধরনের শারীরিক জটিলতার কারণে ওর মধ্যে যে ‘ডিপ্রেশন’ ছিল তা কাটিয়ে প্রাণবন্ত, উচ্ছল হয়ে উঠল। আমার সহকর্মীর পরিবর্তন আর ওর অনুরোধেই কোয়ান্টামকে জানার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠলাম। ওর দেয়া লিফলেট, বিভিন্ন বই পড়ে যতটুকু জানলাম তাতেই মুগ্ধ হলাম। ‘দিন শুরু হোক দানের মাধ্যমে’ এ সস্নোগানের ভিত্তিতে মাটির ব্যাংকে দানের যে প্রক্রিয়া তা আমায় অভিভূত করল। আমার ভাই কোয়ান্টামে নিয়মিত রক্তদাতা। রক্তদান সম্পর্কে ওর কাছে জানলাম। মনে মনে ঠিক করলাম সময় এবং টাকা হলে আমিও চার দিনের কোর্সটি করব।
২৪ এপ্রিল, ২০১৬ শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে সাত দিনের শিক্ষা সফর এবং ট্রেনিংয়ে পাঠাল থাইল্যান্ডে। আমাদের ১৩ সদস্যের টিমে ছিলেন যুগ্ম সচিব মিজানুর রহমান। কোয়ান্টামের নিবেদিত এক ভক্ত। জীবনের সবকিছুতেই তিনি কোয়ান্টাম দেখেন। জীবনের সব প্রাপ্তি, সব সমস্যার সমাধানে তিনি খুঁজে পান কোয়ান্টাম। পরিচিত সবাইকে উদ্বুদ্ধ করেন কোয়ান্টামের কোর্স করে এ সংগঠনের বিশাল পরিবারের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার জন্য। ট্রেনিং শেষে দেশে ফেরার পরও নিয়মিত স্যার খোঁজখবর নিতে লাগলেন। ইতোমধ্যে শুরু হলো কোয়ান্টামের ৪০০তম ব্যাচ। সহকর্মী রুমার উৎসাহে আর মিজান স্যারের আগ্রহে শেষ পর্যন্ত কোর্সের জন্য নাম অন্তর্ভুক্ত করলাম। আমি একা যাতায়াত করতে পারব না তাই রুমা নানা সমস্যা থাকা সত্ত্বেও পুনরায় আমার সঙ্গে কোর্সটি করল। যে চার দিন কাকরাইলে কোর্সটি করলাম সে চার দিন বিরতির সময় প্রতিদিন মিজান স্যার এসে খবর নিতেন কেমন লাগছে?
হাজার হাজার মানুষ অথচ অভূতপূর্ব শৃঙ্খলা। স্বেচ্ছাসেবক দলের আচরণ, কর্মকা-, সেবাদানের মানসিকতা সর্বোপরি তাদের নিবেদিত কর্মস্পৃহায় শুরুতেই মুগ্ধ হলাম। থাইল্যান্ডে গিয়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম ওই দেশের রাস্তাঘাটে উচ্চ শব্দে কাউকে কথা বলতে শুনিনি, রাগ বা চেঁচামেচি কোথাও দেখিনি। উত্তেজিত আচরণ কোথাও খুঁজে পাইনি। কোয়ান্টামে এসে দেখলাম হাজার হাজার মানুষের শৃঙ্খলাবোধ, মার্জিত আচরণ, হাসিমুখে কোমল স্বরে কথা, সুন্দর বাচনভঙ্গি। শুরুতেই মনে হলো, আমরাও পারি। মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানের একই সঙ্গে একই সৃষ্টিকর্তার মহিমা উপলব্ধির এমন অসাধারণ অনুভব আর কোথাও আছে কিনা আমার জানা নেই। সারা দিনের ১০ ঘণ্টার রুটিনে দেড় ঘণ্টা জোহরের নামাজের বিরতি আর আধা ঘণ্টা করে এক ঘণ্টা দুপুরের বিরতি আর আসরের নামাজের বিরতি বাদে বাকি সাড়ে সাত ঘণ্টা একজন বয়স্ক লোক দাঁড়িয়ে একা কথা বলে কী করে হাজার হাজার মানুষকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো অভিভূত করেন, তা সত্যিই বিস্ময়ের ব্যাপার। ধর্ম এবং দৈনন্দিন জীবনাচার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার মাধ্যমে যুক্তিযুক্তভাবে সহজ এবং সাবলীল ভাষায় তুলে ধরে নতুন এক জীবনবোধের বীজ বপন করেন কোয়ান্টামের প্রতিষ্ঠাতা ‘গুরুজি’ বলে সবাই যাকে সম্বোধন করেন সেই স্বপ্নদ্রষ্টা শহীদ আল বোখারী মহাজাতক। কোয়ান্টামের সস্নোগান ‘সুস্থ জীবন, প্রশান্ত মন, কর্মব্যস্ত সুখী জীবন’। এ সস্নোগান আর দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের মাধ্যমে ২০২৫ সালের মধ্যে দেশকে বদলে ফেলার স্বপ্ন দেখেন গুরুজি, তার স্বপ্নের লক্ষ্যে পেঁৗছার এই পথচলায় সারথি তার সহধর্মিণী। সবাই যাকে সম্বোধন করেন ‘মা-জি’ বলে।
১৯৭৫ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞানী ডা. হারবাট বেনসনের মেডিটেশন-সংক্রান্ত অনুসন্ধানী গ্রন্থ ঞযব জবষধীধঃরড়হ জবংঢ়ড়হংব প্রকাশিত হয়। এ বইয়ের ২৫ বছর পূর্তি সংস্করণের ভূমিকায় ২০০০ সালে ডা. বেনসন বলেন, ‘আমরা বিগত বছরগুলোয় হাজার হাজার রোগীর চিকিৎসা করেছি। দেখেছি শিথিলায়ন ও স্বপরিচর্যার মাধ্যমে মনোদৈহিক ব্যাধিগুলোর উপশম বা পূর্ণ নিরাময় হতে পারে। এই খরচহীন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের চিকিৎসা খাত থেকে বার্ষিক ৫০ বিলিয়ন ডলার বাঁচানো সম্ভব।’
১৯৯৫ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞানের সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব হেলথ সব ক্রনিক ব্যথা নিরাময়ে শিথিলায়নকে চিকিৎসা প্রক্রিয়ার মূলধারায় অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। যুক্তরাষ্ট্রের হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভ এবং সিনেটে ডা. বেনসনের সাক্ষ্যের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৯ সালে ‘সেন্টার ফর মাইন্ড বাউ ইন্টারেকশন অ্যান্ড হেলথ’ স্থাপনের জন্য সরকার ১০ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করে। (তথ্য ৩০০তম কোর্সপূর্তি স্মারক। কোয়ান্টাম উচ্ছ্বাস)
খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে আমরা খেয়ে-দেয়ে মোটামুটি হৃষ্টপুষ্ট। বেড়েছে আমাদের ক্রয়ক্ষমতা। ভোগবাদী জীবন ধীরে ধীরে গ্রাস করছে আমাদের। ফলে আত্মায় আমরা দীনহীন হতে বসেছি ধীরে ধীরে। তাই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অসাধারণ যে দৃষ্টান্ত আমাদের মাঝে ছিল তা বিলুপ্ত হতে যাচ্ছে। সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে মানুষে মানুষে বিভেদের নতুন সংস্কৃতি শুরু হয়েছে দেশে। বর্তমান সময়ের এই ক্রান্তিলগ্নে, মানুষের অসম্মানের মহোৎসবের পৈশাচিক উল্লাসের সময়ে কোয়ান্টাম মুক্তির আদর্শ নিয়ে দ-ায়মান। নেতিবাচক চিন্তা পরিহার করে ইতিবাচক চিন্তা আর দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কী করে নিজেকে এবং আশপাশের সবাইকে বদলে ফেলা সম্ভব তারই মন্ত্র শিক্ষা দেয় কোয়ান্টাম। কোয়ান্টামের এ মহতী যাত্রায় সহযাত্রী সব ধর্মের, সব বর্ণের মানুষ। আমিত্বের স্বার্থপরতার শৃঙ্খল ভেঙে আমাদের বিশালতায় পথ চলতে শেখাচ্ছে কোয়ান্টাম। সংঘবদ্ধ দানের মাধ্যমে নানা সেবামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে বদলে দিচ্ছে দেশ। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে ধর্মান্ধতার পথ ছেড়ে ধর্মভীরুতার পথচলার দীক্ষা পাচ্ছে প্রতিটি ধর্মের মানুষ। পবিত্র কোরআনের মর্মবাণী শোনার জন্য যখন হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সবাই পিনপতন নীরবতায় বসে থাকে তখন মনেই হয় না এ বাংলাদেশেই ধর্মান্ধদের পৈশাচিকতায় ভাঙা হয় মহামতি বুদ্ধের মূর্তি, ধুলায় মেটানো হয় পূজার সামগ্রী, ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়া হয় দুর্গা, কালী, সরস্বতীর মূর্তি। ধর্মের নামে বোমা মেরে উড়িয়ে দেয়া হয় তরতাজা প্রাণ। ধর্মীয় বোধ আর মানবতার নতুন এক উপলব্ধির শিক্ষা কোয়ান্টাম। এখানে এসে মনে হলো, আরো আগে, যৌবনের ঊষালগ্নে যখন মানবসেবার স্বপ্ন ছিল চোখে তখন কেন এলাম না।
সেবার হাত প্রসারিত করে, দানের মাধ্যমে কী করে সমাজ বদলে দেয়া যায়, ধ্যানের মাধ্যমে মস্তিষ্ককে কী করে ঠা-া রেখে জীবনকে রাগ, ক্ষোভ থেকে মুক্ত রাখা যায়, ভোগবাদী জীবনের স্বার্থপরতা থেকে মুক্ত হয়ে জীবনকে মানবতার আদর্শে গড়ে তোলা যায় কী করে, তারই এক নীরব বিপ্লব ঘটাচ্ছে কোয়ান্টাম। ব্যক্তি থেকে গোটা জাতিকে বদলে দেয়ার প্রত্যয়ে, সুস্থ, সুন্দর, শৃঙ্খলাবদ্ধ, ধর্মভীরু, বিজ্ঞানসম্মত এক জাতি গঠনের প্রত্যয়ে গুরুজি মহাজাতক শহীদ আল বোখারী এবং তার সহধর্মিণী মা-জি নাহার আল বোখারী কাজ করে যাচ্ছেন। নিঃসন্তান এ দম্পতির হাজার হাজার লাখ লাখ সন্তান এ দেশে তাদের স্বপ্নের বাস্তবায়নে কাজ করছে।
দারিদ্র্য বিমোচনে নানামুখী প্রকল্প, দরিদ্র শিশুদের স্কুল, বৃদ্ধাশ্রম, এতিমখানা এবং দেশের সর্ববৃহৎ স্বেচ্ছায় রক্তদান সংস্থাসহ নানামুখী সেবাদান কার্যক্রম পরিচালনা করে কোয়ান্টাম। কোয়ান্টামের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ‘কোয়ান্টাম কসমো স্কুল’। বিজয় দিবসের প্যারেড ও ডিসপ্লেতে অংশ নিয়ে ওরা প্রতিবারই অর্জন করে প্রথম পুরস্কার। এই স্কুলের শিক্ষার্থীরা এখন বুয়েট, মেডিকেল, নানা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বড় বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত। স্বার্থপরতা আর ধর্মান্ধতার গাঢ় অন্ধকারে নিমজ্জিত দেশ যখন বৈরী এক সময় পার করছে, তখন এ দেশেই ধীর সন্তর্পণে আলোকবর্তিকা হাতে অতীতের আলোকোজ্জ্বল সময়কে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে এ দেশেরই মানুষ।
কোয়ান্টাম এতদিন ভ্যাটমুক্ত ছিল। এ বছর বাজেটে কোয়ান্টামকে ভ্যাটের আওতায় আনা হয়েছে। যে প্রতিষ্ঠানের টাকায় বান্দরবানের লামায় গড়ে উঠেছে স্বপ্নের মতো অন্য এক বাংলাদেশ সেই প্রতিষ্ঠানকে ভ্যাটের আওতায় না এনে, যারা নেশার টাকায় গড়ে তুলছে সুরম্য প্রাসাদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকায় ক্যাসিনোতে জুয়ার আড্ডা বসাচ্ছে তাদের দিকে নজর দিলে দেশ হয়তো আরো কিছুটা এগিয়ে যেত।
কোনোরকম বিদেশি সাহায্য ছাড়া নিজেদের অর্থায়নে যারা গড়ে তুলছে ইতিবাচক ধ্যান-ধারণার, কুসংস্কারমুক্ত অনন্য এক জাতি ভ্যাটের খড়্গ তাদের্তপর না নামালেই কি চলত না? সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আবেদন_ কোয়ান্টামকে জানুন, দেখুন, বুঝুন এবং ভবিষ্যৎ সোনার বাংলা গঠনে, ইহকালের মার্জিত জীবনবোধ এবং পরকালের অনন্তযাত্রার একাকী সফরকে বোঝার জন্য কোয়ান্টামের নিরলস যে পথচলা তাকে সহায়তার জন্য ভ্যাটমুক্ত করা হোক কোয়ান্টামকে। পবিত্র রমজানের এই রহমতের সময়ে দাঁড়িয়ে শুধু নিজের দেশ নয়ম, সারা বিশ্বের মানুষের কল্যাণ কামনায় আমাদের জীবন সুন্দর হোক, পবিত্র হোক, শুদ্ধ হোক।
শাকিলা নাছরিন পাপিয়া:শিক্ষক ও কলাম লেখক