পলাশী দিবস

২৩ জুন ঐতিহাসিক পলাশী ট্রাজেডির দিন। পলাশী দিবস। এই দিন বেঈমানদের বিশ্বাস ঘাতকতায় পলাশীর আম্র কাননে অস্তমিত হয় বাংলার স্বাধীনতার শেষ সুর্য।পলাশীর এই পরাজয় পরাধীনতার শৃংখলে আবদ্ধ হয়ে পড়ে আমাদের স্বাধীনতা-জাতী। ২৫৬ বছর আগে এ দিনে পলাশীর আম্র-বাগানে ইংরেজদের সঙ্গে এক যুদ্ধে বাংলা বিহার ও উড়িষ্যার শেষ নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পরাজয়ের মধ্য দিয়ে অস্তমিত হয় বাংলার স্বাধীনতার সুর্য।করুন পরাজয়ের পর নবাবের করুন মৃত্যু হয়েছিল টিক,কিন্ত উপমহাদেশের মানুষ নবাবকে আজও শ্রদ্ধা ভরে স্মরনে রেখেছে স্বাধীনতার সুর্য সন্তান-বীর সেনানী হিসেবেই।এদেশের স্বাধীনতার প্রতীক,বীর নবাব সিরাজউদ্দৌলা মাত্র ১৫ মাস ক্ষমতার মসনদে আসীন ছিলেন।তিনি ছিলেন তৎকালীন পৃথিবীর একজন অসাধারণ প্রতিভাধর নির্ভেজাল দেশ প্রেমিক শাসক তাতে সন্দেহ নেই।একাধারে একজন সৎসাহসী, দূরদৃষ্টি সম্পন্ন শাসক ছিলেন নবাব সিরাজ উদ দৌলা,ইতিহাস স্বাক্ষ্য দেয়। ক্ষমতাসীন হয়ে সবকিছু সুসংহত করার আগেই বিশ্বাসঘাতকদের আঘাত লন্ডভন্ড করে দেয় প্রত্যাশা ও সৎ পরিকল্পনা।যার ফলশ্র“তিতে বাংলার জনগনের ভাগ্যে দীর্ঘমেয়াদী কলঙ্কের তিলক লেপ্টে যায়,পরাধীনতার কালো মেঘে ঢাকা পড়ে জনতার ভাগ্য।দ্বীর্ঘ পরাধীনতার অপছায়া গ্রাস করে বাংলা এবং বাংলার জনগনকে।
ইতিহাসবিদ নিখিল নাথ রায়ের লেখা “মুর্শিদাবাদ কাহিনী’ থেকে জানা যায়, “নবাবের সেনা বাহিনীর তুলনায় ইংরেজদের সেনা সংখ্যা ছিল অনেক কম। সেখানে বিশ্বাসঘাতকতা না হলে নবাবের বিজয় ছিল সুনিশ্চিত। আলীবর্দী খাঁর পর ১৭৫৬ সালের ১০ এপ্রিল সিরাজউদ্দৌলা বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার সিংহাসনে আসীন হন। তখন তার বয়স মাত্র ২২ বছর। তরুণ নবাবের সাথে ইংরেজদের বিভিন্ন কারণে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়।এছাড়া, রাজ সিংহাসনের জন্য লালায়িত ছিলেন, সিরাজের পিতামহ আলীবর্দী খাঁর বিশ্বস্ত অনুচর মীর জাফর ও খালা ঘষেটি বেগম। ইংরেজদের সাথে তারা যোগাযোগ স্থাপন কার্যকর করে নবাবের বিরুদ্ধে নীলনকশা পাকাপোক্ত করে।
১৭৫৭ সালের ২৩ এপ্রিল কোলকাতা পরিষদ নবাবকে সিংহাসনচ্যুত করার পক্ষে প্রস্তাব পাস করে। এ প্রস্তাব কার্যকর করতে ইংরেজ সেনাপতি লর্ড ক্লাইভ রাজদরবারের অভিজাত সদস্য উমির চাঁদকে এজেন্ট নিযুক্ত করেন।এ ষড়যন্ত্রের নেপথ্য নায়ক মীরজাফর, তা আঁচ করতে পেরে নবাব তাকে প্রধান সেনাপতির পদ থেকে অপসারণ করে আব্দুল হাদীকে অভিষিক্ত করেন। কূটচালে পারদর্শী মীর জাফর পবিত্র কুরআন শরীফ ছুঁয়ে শপথ করায় নবাবের মন গলে যায় এবং মীর জাফরকে প্রধান সেনাপতি পদে পুনর্বহাল করেন”। সমসাময়িক ঐতিহাসিকরা বলেন, এই ভুল সিদ্ধান্তই নবাব সিরাজের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়।ইংরেজ কর্তৃক পূর্ণিয়ার শওকত জঙ্গকে সাহায্য করা, মীরজাফরের সিংহাসন লাভের বাসনা ও ইংরেজদের পুতুল নবাব বানানোর পরিকল্পনা, ঘষেটি বেগমের সাথে ইংরেজদের যোগাযোগ, নবাবের নিষেধ সত্ত্বেও ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ সংস্কার, কৃষ্ণ বল্লভকে কোর্ট উইলিয়ামে আশ্রয় দান প্রভৃতি কারণে ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন ভাগীরথী নদীর তীরে পলাশীর আম্রকাননে সকাল সাড়ে ১০টায় ইংরেজ ও নবাবের মধ্যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়। আর প্রধান সেনাপতি মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতায় নবাবের শোচনীয় পরাজয় ঘটে। বেদনাদায়ক এই পরাজয়ে শুধু নবাব নয়,বাংলার আকাশে দুর্যোগ আর পরাধীনতার অপছায়া নেমে আসে। তবে অনেকের মতে,মীর জাফরকে প্রধান অভিযুক্ত করা হলেও ষড়যন্ত্র ছিল সুদুর প্রসারী, যা ঐতিহাসিক মোহর আলীর বক্তব্যে পৃষ্ট- “মীরজাফর যদি এই চক্রান্তে যোগ নাও দিত ষড়যন্ত্রকারীরা অন্য কাউকে খুঁজে নিত”। ধূর্ত ইংরেজরা সন্ধির চুক্তি ভঙ্গ করে চন্দননগরের ফরাসীদের দুর্গ দখল করে,নবাবকে ক্ষমতাচ্যুত করার ফন্দি আটে। নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে কুচক্রের ফাঁদে পড়ে জীবন দিয়ে গেলেও তার অবদান, ভালোবাসা বাঙালিদের মনে অম্লান হয়ে থাকবে। ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ থাকবে তার কীর্তি।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, মীর জাফর ও ঘষেটি বেগমের প্রচণ্ড ক্ষমতালোভী মনোভাবের কারনেই ইতিহাসের ঘৃন্য ঘটনা পলাশীর র্প্রান্তরকে করেছে কলঙ্কময়। যুদ্ধ নামের নাটকের মাধ্যমে জাতীয় বেঈমানরা দেশ ও জাতির সাথে চরম বিশ্বাসঘাতকতা করে,বাংলার স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বকে বিক্রি করে দেয় বিদেশীদের হাতে,যারা শাসন নয় শোষনেই ছিল পারদর্শী। আর ঘৃণিত কলঙ্ক জনক এই ষড়যন্ত্রের অধ্যায় সৃষ্টির পেছনে জড়িত সেই বিশ্বাসঘাতকরা আজ ঘৃণার পাত্র হিসেবে ইতিহাসের ঘৃণ্য আস্তাকুড়ে ঠাঁই নিয়েছে। আর বাংলা জুড়ে মীরজাফর আজ গালি ।নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার মৃত্যুর সাথে অস্তমিত হয় বাংলার স্বাধীন সুর্যও।১৭৫৭ সালের এই পলাশী প্রান্তরের দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার মধ্য দিয়ে বাংলার সাড়ে পাঁচশ বছরের মুসলিম শাসনেরও অবসান ঘটে,যাতে বিপন্ন হয় রাষ্ট্রের ভিত্তি।পিছিয়ে পড়ে স্বাধীনতার অগ্রগামীতা,শাসনের নামে চলে শোষন।
ঐতিহাসিক এই ঘটনা থেকে আমাদের শিক্ষা নেওয়া দরকার। কারন দেশের স্বাধীনতা-স্বার্বভৌমত্বকে ধ্বংসের ঘড়যন্ত্রকে সুযোগ সন্ধানীরা এখনো তৎপর।ঐতিহাসিক পলাশী দিবসের শিক্ষা আমাদের জাতিসত্তার বিকাশে সঠিক নির্দেশনা দিতে পারে। স্বাধীনতার চেতনাকে ধারন করে এ দিবসের প্রকৃত শিক্ষা ও সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে আমাদেরকে উদ্যোগী হতে হবে । সাথে সাথে এদেশের স্বাধীনতা রক্ষার লড়াইয়ে অনুপ্রেরণা নবাব সিরাজ উদ দৌলার আদর্শকে নতুন প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে। ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে নব্য মীরজাফর ও ভিনদেশী শত্রুদের সকল ষষড়যন্ত্র যেন রুখে দিতে আমাদের উচিত গণতান্ত্রিক চর্চাকে অব্যহত রেখে দেশের স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করে যাওয়া।সত্য বলতে- কখনো মৃত্যু নেই সত্যের,সাময়িক হারকে পরাজয় বলে দমে যাওয়া বোকামী। কবির ভাষায়-নিষিক্ত ফুলের পাপড়ি হারানো পরাজয় নয়,আগামীর প্রতিশ্রুতি…।আমাদেরকে নব্য মীরজাফর-দেশ বিরোধীদের চিহ্নিত করতে হবে,যারা নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থে দেশ জাতির স্বার্থকে জলাঞ্জলি দেয়ার অপতৎপরতায় লিপ্ত, যারা দেশের সার্বভৌমত্বকে অবমাননা করে ভিনদেশীদের খুশিতে উৎসাহ দেখায়। সত্যের ঝান্ডাকে সমুন্নত রাখতে মীর জাফরের চেলাদের প্রতিহত করা সময়ের দাবী।যুগে যুগে নব্য মীর জাফরদের আর্বিভাব ঘটেছে,আরো ঘটবে তাকে দমে যাওয়ার কিছু নেই,প্রয়োজন ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্ঠায় দেশ বিরোধী সকল ষড়যন্ত নস্যাত করে দেয়া।ইতিহাসের প্রত্যেকটি ঘটনাই ভবিষ্যতের জন্য শিক্ষা হিসেবে কাজে দেয় ,তাই ঐতিহাসিক পলাশী দিবসে আমাদের প্রত্যাশা হোক বিশ্বাসঘাতকদের সকল ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে এগিয়ে যাওয়া।বাংলার স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে সমুন্নত রাখতে-পলাশীর শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে আমাদের দল-মত,জাতী-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে কাজ করে যাওয়া।
(তথ্যসূত্র:ইউকিপিডিয়া ও ই.নেট)