বিভাগীয় খবরময়মনসিংহ

ফকির বিদ্রোহের নিদর্শন ‘বিবির ঘর’ ধ্বংসের পথে

মনোনেশ দাস: ময়মনসিংহে ফকির বিদ্রোহের নিদর্শন সংস্কার ও যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে ধ্বংসের পথে। ঐতিহাসিক ফকির বিদ্রোহের নিদর্শন একটি ঘর আজো আছে। এলাকাবাসী যার নামকরণ করেছেন ‘বিবির ঘর’ হিসেবে।

জানা গেছে, ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা শহর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে দাওগাঁও ইউনিয়নের খাজুলিয়া দক্ষিণ পাড়ায় প্রত্নতত্ত্ব সম্পদ বিবির ঘরটি। ধারণা করা হয়, ১৭শ দশকের শেষ দিকে  ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ফকির-সন্যাসীরা এই ঘরটি নির্মাণ করেন। সাধারণ মানুষের অধিকার আদায় করতে বিদ্রোহী ফকিররা ইংরেজদের তল্পীবাহক সামন্ত জমিদারদের অপহরণ করে এই বিবির ঘরে রাখতেন।

লোকমুখে শোনা যায়, সেসময় ঘন জঙ্গলে আবৃত এই অঞ্চল ছিল হিংস্র পশু-পাখির অবাধ বিচরণ। অপহৃত জমিদারদের সুরক্ষার লক্ষ্যে ইটপাথরে গড়ে তোলা হয় এই বিবির ঘর।

স্থানীয় বাসিন্দা জয়নাল আবেদীন (৭৫) জানান, শিশু বয়সে দেখেছি বিবির ঘরের নিকটবর্তী পুকুর পর্যন্ত একটি পাকারাস্তা ছিল। এখন এই রাস্তার অস্তিত্ব নেই।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৭৬৪ সালে মীর কাসেমের পরাজয়ের পর ইস্টইন্ডিয়া ‘দেওয়ানি’ লাভ করে যখন তাদের অত্যাচারমূলক শাসন দ- চালাতে শুরু করে তারপর থেকে ফকির বিদ্রোহ শুরু হয় এবং এর পরিসমাপ্তি ঘটে ১৮৩৩ অথবা ১৮৩৪ সালে। বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন স্থানে যে ফকির বিদ্রোহ হয়েছিল, তাদের মধ্যে কোন যোগসূত্র ছিল কিনা, তাও বলা কঠিন। তাদের অভিযানের মূল উদ্দেশ্য ছিল ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির সৃষ্ট ও আশ্রয়পুষ্ট শোষণকারী, জমিদারদের উচ্ছেদ করা ও তাদের অর্থাগার লুট করা। উত্তরবঙ্গে এদের অভিযানের ফলে বহু জমিদার ইতিপূর্বেই ১৭৭৩ সালে ময়মনসিংহ জেলার বিভিন্ন স্থানে এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন।

ফকির আন্দোলনে যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তাদের উল্লেযোগ্য হলেন- মজনু শাহ, মাজু শাহ, টিপু পাগল ও গজনফর তুর্কশাহ।

খালেকদাদ চৌধুরী তার ‘ময়মনসিংহে ফকির অভিযান’ প্রবন্ধে মজনু শাহকে মাজু শাহের বড়ো ভাই উল্লেখ করেছেন। তার সম্পর্কে এতটুতু জানা যায় যে, ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের বিরুদ্ধে তিনি একটি সশস্ত্র বাহিনী গঠন করেন। ১৭৮৪ সালে মাজুশাহ ময়মনসিংহ, আলাপসিং, জাফরশাহী এবং শেরপুর পরগণার জমিদারদের সব ধনদৌলত লুন্ঠন করেন। সেখানে সংবাদ রটে যে, মাজু শাহের ভাই মজনু শাহ দুইশ দুর্ধর্ষ ফকিরসহ জাফরশাহী পরগণায় আসছেন। তার এই অভিযানের ভয়ে জমিদার এবং প্রজারা অন্যত্র পালিয়ে যায়।

কিন্তু ঢাকার চিফ মি. ডে-র রিপোর্ট থেকে জানা যায়, বেগমবাড়ীর সৈন্যবাহিনীই সেই অভিযান প্রতিরোধ করে। ফলে ফকিরেরা ফিরে যায়।

মি. ডে-র রিপোর্টে আরও উল্লেখ আছে, জমিদারদের ধন সম্পদ লুণ্ঠনের ব্যাপারটি সত্য নয়। খাজনা ফাঁকি দেয়ার জন্যে সুচতুর ও অসাধু জমিদাররা এরূপ মিথ্যা সংবাদ রেভেনিউ কমিটির কাছে পাঠিয়েছিল। আবার ফকির অভিযান শুরু হয় দু’বছর পর ১৭৮৬ সালে। ময়মনসিংহকে ফকিরদের আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্যে লেফটন্যান্ট ফিল্ডকে ঢাকা পাঠানো হয়। ময়মনসিংহের কলেক্টর রাউটনের সাহায্যের জন্যে আসাম গোয়ালপাড়া থেকে ক্যাপ্টেন ক্রেটনকে পাঠানো হয়। সুসজ্জিত ইংরেজ সৈন্যদের সাথে ফকিরদের সঙ্গে প্রচ- সংঘর্ষ হয়, তাতে ফকির বাহিনী পরাজিত হয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। তারপর আর বহুদিন তাদের কোনো তৎপরতার কথা জানা যায় না।

ফকিরদের অভিযান বন্ধ হওয়ার পর জমিদাররা তাদের ক্ষয়ক্ষতি পূরণের নাম করে প্রজাদের নিকট থেকে বর্ধিত আকারে রাজস্ব আদায় করতে থাকে এবং নতুন কর ধার্য করতে থাকে। তাতে প্রজাদের দুর্দশা চরমে পৌঁছে।

প্রজাদের নির্যাতনের অবসানকল্পে ১৮২৬ সালে টিপু পাগল নামক জনৈক প্রভাবশালী ফকির কৃষক প্রজাদের নিয়ে এক শক্তিশালী বাহিনী গঠন করেন। জমিদারেরা সকল ন্যায়নীতি ও ১৭৯৩ সালের রেগুলেশন নং-৮ অগ্রাহ্য করে প্রজাদের উপর নানাবিধ ‘আবওয়াব’ ধার্য করতে থাকে। এসব আবওয়াব ও নতুন নতুন উৎপীড়নমূলক কর জবরদস্তি করে আদায় করা হতো। ১৮২৫ সালে টিপুর নেতৃত্বে ফকির দল জমিদারদের খাজনা বন্ধের আন্দোলন করে। জমিদারদের বরকন্দাজ বাহিনী ও ফকিরদের মধ্যে এক সংঘর্ষে করকন্দাজ বাহিনী নির্মূল হয়ে যায়। জমিদারদের মধ্যে এক সংঘর্ষে বরকন্দাজ বাহিনী নির্মূল হয়ে যায়।

আঞ্চলিক অধিবাসীদের ধারণা, ফকির আন্দোলনের ওই সময় নির্মাণ করা হয় এই ‘বিবির ঘর’। এলাকাবাসী প্রাচীন এই স্থাপনা সংরক্ষণ ও সংস্কারের দাবি জানান।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button