টঙ্গীতে কারখানায় বয়লার বিস্ফোরণ, মৃতের সংখ্যা বেড়ে ২৪

নিহতদের মধ্যে ১৯ জনের লাশ টঙ্গী হাসপাতালে রয়েছে। সাতজনের লাশ রয়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। টঙ্গী হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক মো. পারভেজ মিয়া জানান, হাসপাতালে নারী ও শিশুসহ ১৭ জনের লাশ রয়েছে। এছাড়া আহত ১২ জনকে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।
টঙ্গীতে থাকা যাদের পরিচয় নাম গেছে, তারা হলেন- আনিসুর রহমান (প্রকৌশলী), জয়নাল আবেদিন (অপারেটর), আনোয়ার হোসেন (অপারেটর), শংকর (ক্লিনার), রেদোয়ান (দারোয়ান), জাহাঙ্গীর (নিরাপত্তাকর্মী), হান্নান মিয়া (নিরাপত্তাকর্মী), রফিকুল ইসলাম (শ্রমিক), ইদ্রিস, আল মামুন, নয়ন, সুভাষ, জাহিদুল, রাশেদ (রিকশাচালক)।
অগ্নিকাণ্ডের পরপরই কারখানার শ্রমিকদের স্বজনরা টঙ্গী ৫০ শয্যার হাসপাতালে গিয়ে ভিড় জমায়। লাশ দেখে পেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। অনেকে স্বজনদের খুঁজছিল। নিখোঁজ ক্লিনার রাজেশের দাদি জানান, ঘটনার পর থেকে তার খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।
শুরুতে কারখানা থেকে হতাহতদের উদ্ধার করে টঙ্গী হাসপাতালে নেয়া হলেও সেখান থেকে গুরুতর আহতদের ঢাকা মেডিকেল ও উত্তরা মেডিকেলে পাঠানো হয়।
উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার সাব্বির আহমেদ জানান, সেখানে নেয়া দুজনের মৃত্যু হয়েছে। পরে লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
ঢামেক পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ উপ-পরিদর্শক বাচ্চু মিয়া জানান, এই হাসপাতালে এক নারীসহ সাতজনের লাশ রয়েছে। তাছাড়া ভর্তি রয়েছেন আরও ১৮ জন, তারা সবাই পুরুষ।
মৃত পাঁচজনের নাম জানা গেছে, তারা হলেন- অপারেটর সিরাজগঞ্জের ওয়াহিদুজ্জামান স্বপন (৩৫), হবিগঞ্জের তাহমিনা আক্তার (৫০), আশিক (১২), আনোয়ার হোসেন (৪০) ও দেলোয়ার হোসেন (৫০)।
ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটের আবাসিক চিকিৎসক পার্থ শঙ্কর পাল জানান, আহতদের মধ্যে চারজন তাদের তত্ত্বাবধানে রয়েছেন। এর মধ্যে একজনের শরীরের ছয় ভাগ, আরেকজনের আট ভাগ পুড়েছে। একজনের শরীরের ৯০ ভাগ পুড়ে গেছে, তার অবস্থা আশঙ্কাজনক।
দেহের ছয় শতাংশ পুড়েছে শাহ আলমের (৪৬), দিলীপ দাসের (৩৬) পুড়েছে আট শতাংশ বার্ন। রিপন দাসের (৩০) দেহের ৯০ ভাগ পুড়েছে। এছাড়া রাসেল খান (২৬) নামে একজনও বার্ন ইউনিটে রয়েছেন।
ভর্তি অন্যরা নানাভাবে আঘাত পেয়ে আহত হয়েছেন। তারা হলেন- রাসেল (২২), আনোয়ার (৫০), কামরুল (২৭), মনোয়ার (৩৫), মিজু মিয়া (২৫), ইকবাল (৩৫), শিপন (৩৫), শাহীন আকমল (৩০), রোকন (৩৫), কামরুল (২৭), প্রাণকৃষ্ণ (৩৮), অজ্ঞাত পুরুষ (৫০)।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মিজানুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা আশঙ্কাজনক রোগীদের আগে সেটল করছি। যার যার রক্ত-স্যালাইন প্রয়োজন, আমরা দিচ্ছি।”
১২ বছরের একটা শিশুর কথা উল্লেখ করে তিনি দুপুরে বলেছিলেন, “বাচ্চাটি শকে আছে। তার অপারেশন প্রয়োজন। আমরা তৈরি আছি। প্রয়োজন অনুযায়ী চিকিৎসা দিচ্ছি।” আশিক নামে ওই শিশুটি বেলা ৩টার দিকে মারা যান।
নিহত প্রকৌশলী আনিসুর রহমানের স্ত্রী নিগার সুলতানা জানান, পৌনে ৬টার কিছুক্ষণ পর একটি বিকট বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পান তিনি।
কারখানার পাশে গোপালপুর এলাকায় তার বাসা। শব্দ শুনে বেরিয়ে স্বামীর কারখানা থেকে কালো ধোঁয়া বের হতে দেখে ছুটে যান নিগার। গিয়ে দেখেন তার স্বামীসহ কয়েকজনের লাশ বের করা হচ্ছে।
টঙ্গী রেল স্টেশনের কর্মী লিখন জানান, পাঁচ তলা কারখানার চতুর্থ তলায় বেশ কিছু শ্রমিক জানালা দিয়ে হাত নেড়ে তাদের বাঁচানোর আকুতি জানাচ্ছিলেন। এসময় স্থানীয়রা মই নিয়ে শ্রমিকদের উদ্ধারের চেষ্টা চালায়। কিন্তু ধোঁয়া ও তাপের কারণে তাদের ওই চেষ্টা ব্যর্থ হয়।
“কিছুক্ষণ পরে ওই তলায় থাকা শ্রমিকদের আর কোনো সাড়া দেখা যায়নি। ততক্ষণে আগুন পুরো কারখানায় ছড়িয়ে পড়ে। কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলীতে আশপাশের এলাকাও অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে।”
দুপুর সাড়ে ১২টার দিকেও কারখানাটিতে আগুন জ্বলতে দেখা যাচ্ছিল। তার আগে ভবনের একাংশের ছাদ ধসে পড়ে। আগুন নেভাতে গিয়ে সোহেল নামের এক দমকলকর্মী আহত হন। আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চললেও বাতাসের কারণে বেগ পেতে হচ্ছিল বলে জানান ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তারা।
ভেতরে দেয়াল চাপা পড়ে কিংবা অগ্নিদগ্ধ হয়ে আর কেউ মারা গেছেন কি না, তা আগুন পুরোপুরি নেভানোর আগে বলতে পারছেন না ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তারা।
নিহতদের প্রত্যেকের পরিবারকে ২ লাখ টাকা অনুদান দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। গাজীপুর জেলা প্রশাসন নিহতদের পরিবারকে ২০ হাজার টাকা করে এবং আহতদের ৫ হাজার টাকা করে দিচ্ছে।
কারখানার মালিক সিলেটের সাবেক বিএনপি সাংসদ সৈয়দ মো. মকবুল হোসেন হতাহত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
এই ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করেছে কল কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর। এছাড়া গাজীপুর জেলা প্রশাসন ও ফায়ার সার্ভিসও আলাদা তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।
মকবুল জানান, ১৯৭৭ সালে প্রতিষ্ঠিত তার এই কারখানায় সাড়ে ৪শর মতো শ্রমিক রয়েছে। সবার ঈদের বোনাসসহ বেতন-ভাতা কয়েকদিন আগেই পরিশোধ করা হয়েছিল। “শুক্রবার রাতের পালায় ৭৫ জনের মতো কাজ করছিলেন। শনিবার ঈদের ছুটি হওয়ার কথা ছিল।”