খাদিজাকে হাসপাতালে নেওয়া তরুণের লোমহর্ষক বর্ণনা

সিলেট: সিলেট মহিলা কলেজের সম্মান দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী খাদিজা আক্তার নার্গিসকে হাসপাতালে নেওয়া তরুণ ইমরান কবির দিলেন ঘটনার লোমহর্ষক বর্ণনা। খাদিজাকে বাঁচাতে শরীর থেকে দিয়েছেন রক্তও। সিলেট এমসি কলেজ প্রাঙ্গনে বেড়াতে এসে এমনলোমহর্ষক ঘটনার মুখোমুখি হবেন, ভাবতেও পারেননি এ তরুণ।
ইমরানের বর্ণনায়, তখন বিকেল ৫টা প্রায়। কিছুক্ষণ আগে অনার্স পর্যায়ের বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে। কলেজজুড়ে শিক্ষার্থীদের আনাগোনা। হঠাৎ বড় শব্দে প্রচণ্ড চিৎকার শুনতে পান ইমরান। দেখতে পান, অদূরে এক নারী মাটিতে পড়ে আছেন আর অমানুষিক নৃশংসতায় তাকে কুপিয়ে চলেছে এক যুবক।
পড়ে থাকা ওই তরুণী খাদিজা আক্তার নার্গিস আর চাপাতি ধরা হামলাকারী বদরুল আলম। দুজনের কাউকেই চিনতেন না ইমরান। ঘটনার আকস্মিকতায় মুহূর্তের জন্যে থমকে গিয়েছিলেন। সবাই যার যার মতো দৌড়ে পালাচ্ছে, চিৎকার করছে। কী করবেন তিনি? দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখছে অনেকে। তাদের মতো দূর থেকেই দেখে যাবেন? হাতে ধারালো অস্ত্র ধরা বদরুলকে দেখে এগোতে কেউ সাহস করছিল না। তখন বুকে অসম সাহস নিয়ে ঘটনাস্থলের দিকে দৌড়ুতে শুরু করলেন ইমরান। প্রমাণ করলেন, শেষ পর্যন্ত মানুষ তো মানুষেরই জন্য।
ইমরান যতক্ষণে নার্গিসের কাছে পৌঁছুলেন, ততেক্ষণে বদরুল পালাতে শুরু করেছে। ইমরান নার্গিসের মাথাটা কোলে তুলে চারপাশে তাকিয়ে চিৎকার করে বলেন, ‘আসুনআপানারা! মেয়েটা মারা যাচ্ছে, হাসপাতালে নিতে হবে!’
ইমরানের ডাকে প্রথম প্রথম কেউ সাড়া দেয়নি। পালাতে থাকা বদরুলকে যখন আটকে ফেলা হয়, তখন কিছুটা ভীতিমুক্ত হয়ে এগিয়ে আসেন এমসি কলেজের ছাত্র মাহফুজসহ আরও একজন। তিনজন মিলে নার্গিসের রক্তমাখা দেহটা একটা সিএনজি অটোরিকশায় তুললেন। সারাপথ ভয়ানক যন্ত্রণায় কুঁকড়ে থাকা নার্গিস অবশেষে পৌঁছাল হাসপাতালে।
ইমরান জানান, নার্গিসের দিকে তাকানোর সাহস তার ছিল না। ‘মাথাটা ছিল ক্ষতবিক্ষত। ওদিকে তাকানোর মতো অবস্থা আমার ছিল না। অঝোরে রক্ত ঝরছিল। জামাকাপড় ভিজে একাকার। কোনোভাবেই রক্তপড়া বন্ধ হচ্ছিল না। সিএনজিতে ওঠানোর পরই তার চোখ দুটো উল্টে গেল। আমরা আল্লাহর কাছে আপুর প্রাণ রক্ষার জন্যে প্রার্থনা করছিলাম। উনি হাত মোচড়াচ্ছিলেন। মনে হচ্ছিল সব রগ বুঝি এক হয়ে যাচ্ছে। হাত পা শক্ত করে ধরে রাখছিলাম। মনে হচ্ছিল তিনি মারা যাচ্ছেন।’
হাসপাতালে পৌঁছেই চিৎকার করে বলতে শুরু করেন ইমরান, ‘আপুকে বাঁচান, আপুকে বাঁচান, তিনি মারা যাচ্ছেন!’ প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছিল। দরকার ছিল অনেক রক্তের। নার্গিসের রক্তের গ্রুপ এ পজেটিভ। কাকতালীয়ভাবে ইমরানেরও তাই। ক্লান্ত ইমরান হাসপাতালেই নার্গিসকে ভর্তি করিয়েই দায়িত্ব শেষ করেননি। হাসপাতালের বেডে শুয়ে পড়লেন রক্ত দেওয়ার জন্য। এসময় অঝোর ধারায় কাঁদছিলেন তিনি নিজেও।
সেদিন রাত ১২টা পর্যন্ত হাসপাতালে ছিলেন ইমরান। এরপর নার্গিসকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। নার্গিসকে ঢাকার পথে বিদায় দিয়ে বাসায় ফেরেন ইমরান। রাতে বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে বক্তব্য দেন তিনি। জানান, মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন তিনি। নার্গিসের রক্তমাখা মাথার ছবিটা কিছুতেই ভুলতে পারছেন না। এটুকু শুধু বলেন, ‘আপু জীবন ফিরে পেলে খুশি হবো। এ প্রার্থনার অনুরোধ গোটা দেশবাসীর কাছে রাখছি।’
২০১৫ সালে এইএসসি পাশ করার পর ভালো সাবজেক্ট না পাওয়া কোথাও ভর্তি হননি ইমরান কবির। এ বছর অধ্যয়নের বিষয় হিসেবে ভালো কিছু পাওয়ার আশায় আবার ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সিলেটের কোম্পানীগঞ্জের ঢালারপাড় গ্রামের এই তরুণ।