খেলাধূলা

টাইগারদের বীরোচিত জয়; সিরিজে সমতা

ক্রিড়া প্রতিবেদক: প্রথম ম্যাচে হতে হতে হয়নি। ৩১০ রানের লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে ২৮৮ রানে থেমে যেতে হয়েছিল। তাতে বাংলাদেশ পুরনো চেহারায় ফিরে যাবে- এমন ধারণা যারা করেছিল, তাদেরকে মাশরাফিরা দেখিয়ে দিলেন, বাংলাদেশ যে ধীরে ধীরে বড় দল হয়ে উঠছে, সেই প্রমাণ। যারা প্রথম ম্যাচে ৩০৯ রান করতে পেরেছিল, সেই তাদেরকেই দ্বিতীয় ম্যাচে ২০৪ রানে বেধে ফেলে ৩৪ রানের দারুণ এক জয় তুলে নিলো টিম বাংলাদেশ। ব্রিটেন সাম্রাজ্যের সিংহরা দেখলো, বাঘের গর্জন কেমন হয়। বাঘকে ক্ষেপালে উল্টো সেই বাঘের থাবায় হতে হয় ছিন্ন-ভিন্ন।

২৩৮ রানের পুঁজি নিয়েও যে দুর্দান্ত লড়াই করা যায়, সেটা দেখিয়ে দিলো মাশরাফি অ্যান্ড কোং। জয়ের জন্য ইংল্যান্ড ২৩৯ রান করতে নামার পর যে চিত্র তৈরী হয়েছিল তার সংক্ষিপ্ত রূপ হলো- শুরুতে মাশরাফি ঝড়। মাঝে জনি ব্যারেস্ট এবং জস বাটলারের জুটির ওপর ইংল্যান্ডের ঘুরে দাঁড়ানো। এরপর তাসকিনের আঘাতে সব লণ্ডভণ্ড হয়ে যাওয়া। নাসিরের অতিমাত্রায় নিয়ন্ত্রিত বোলিং। শেষে আবার আদিল রশিদ আর জ্যাক বালের জ্বলে ওঠা, সর্বেশেষ ৪৪.৪ ওভারে ২০৪ রানে অলআউট ইংল্যান্ড। এবং ৩৪ রানের বীরোচিত জয়ে সিরিজে সমতা ফিরিয়ে আনলো টিম বাংলাদেশ।

ইংলিশ শিবিরে তাণ্ডব নৃত্যের শুরুটা করেছিলেন মাশরাফি বিন মর্তুজা। ব্যাট হাতে ঝড় তুলেছিলেন নিজেদের ইনিংসের শেষ দিকে এসে। বল হাতে ঝড় তুললেন শুরুতেই। সবাই জানতো- ২৩৮ রানের পুঁজি নিয়ে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে লড়াই করাটা বেশ দুরহ। এমন পরিস্থিতিতে শুরুতেই প্রয়োজন ছিল ব্রেক থ্রু এনে দেয়ার। সেই ব্রেক থ্রুটা এনে দিলেন অধিনায়ক মাশরাফিই। তার গর্জনের সামনে শুরুতেই খাবি খেতে লাগলো সফরকারী ইংল্যান্ড। মাশরাফির তোপে মাত্র ২৬ রানেই ৪ উইকেট হারিয়ে বসলো ইংল্যান্ড।

ওই সময় মাশরাফি নিলেন তিনটা, সাকিব একটা। মাশরাফি ফেরান জেমস ভিন্স, জেসন রয় এবং বেন স্টোকসকে। সাকিব ফেরান বেন ডাকেটকে। প্রথম ম্যাচে বাংলাদেশের জন্য ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছিলেন বেন ডাকেট আর বেন স্টোকস। জুটি গড়েছিলেন ১৫৩ রানের। বেন ডাকেট ৬৩ রান করেছিলেন আর বেন স্টোকস করেছিলেন সেঞ্চুরি। অথচ আজ এ দু’ ব্যাটসম্যানই মারলেন গোল্ডেন ডাক। দু’জনই আউট হলেন শূন্য রান করে।

যদিও এরপর মিডল অর্ডারে জনি ব্যারেস্ট আর অধিনায়ক জস বাটলারের ব্যাটে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল ইংল্যান্ড। যে ঝড় মাশরাফি-সাকিব তুলেছিলেন, সেটা কিছুক্ষণের জন্য ধরে রাখতে পারেনি পরের বোলাররা। তাসকিন তো দুই ওভারের স্পেলে দিলেন ১৯ রান। বাধ্য হয়ে তাকে সরিয়ে ফেলেন মাশরাফি। শফিউল কিংবা নাসিরকে এনেও সাফল্য পাচ্ছিলেন না মাশরাফি। বরং বাংলাদেশের বোলারদের বেশ স্বচ্ছন্দেই খেলে ম্যাচ বের করে নেয়ার দিকে মনযোগি হয়েছিল ইংল্যান্ডের এই দুই ব্যাটসম্যান।

বাটলার-ব্যারেস্ট মিলে গড়ে ফেলেছিলেন ৭৯ রানের জুটি। তাদের এই জুটিতে ধীরে ধীরে যেন ম্যাচ মাশরাফিদের হাতের মুঠো গলে বের হয়ে যাচ্ছিল। ওই সময় মাশরাফি বোলিংয়ে নিয়ে আসলেন প্রথম স্পেলে খরুচে বোলার তাসকিনকে। তবে মাশরাফি তাকে প্রান্ত বদল করে দেন। এবার তাসকিন জ্বলে উঠলেন স্বরূপে। এসেই তিনি ভেঙে দিলেন ইংল্যান্ডের দুর্ধর্ষ এই জুটি। জনি ব্যারেস্টকে ক্যাচ দিতে বাধ্য করলেন উইকেটের পেছনে মুশফিকের হাতে। ৪ উইকেটে ২৬ রান থেকে ইংল্যান্ড ৫ উইকেটে ১০৫।

এরপরও ইংল্যান্ডের জয়ের সম্ভাবনা ছিল। ছিলেন অভিজ্ঞ মঈন আলি। জস বাটলারের সঙ্গে জুটি বাধতে মাঠে নামেন তিনি। তবে আজ আর অভিজ্ঞতা কাজে লাগেনি। নাসির হোসেনের বলে মিডউইকেটে বল তুলে দেন মঈন। অনেকটা ঝাঁপিয়ে পড়ে দুর্দান্ত এক ক্যাচ নেন সাকিব আল হাসান। এরপরই তাসকিন আহমেদের দুর্দান্ত এক ডেলিভারিতে পরাস্ত হলেন জস বাটলার। লেগ বিফোরের জোরালো আবেদনে আম্পায়ার সাড়া দেননি। তাসকিন আর মাশরাফির বিশ্বাস, লাইনেই ছিল বলটা। ফলে রিভিউর আবেদন করলেন তারা। টিভি রিপ্লেতে দেখা গেলো সত্যি সত্যি লাইনে ছিল বল এবং মিস করলে নিশ্চিত বোল্ড। সুতরাং, রিভিউতে জিতলেন মাশরাফিরাই। ইনিংস সেরা ৫৭ রান করে ফিরে গেলেন ইংল্যান্ডের শেষ ভরসা জস বাটলারও।

এরপর ক্রিস ওকসকে সাজঘরে ফেরালেন তাসকিন আহমেদ। ৯ রান করা ডেভিড উইলিকে ফেরান মোসাদ্দেক হোসেন। এরপর যেন নিভে যাওয়ার আড়ে ধপ করে জ্বলে উঠলো ইংলিশদের শেষ জুটি। আদিল রশিদ আর জ্যাক বাল ভালোই ভোগান্তি তৈরী করেছিল। দু’জ মিলে ৪৫ রানে জুটি গড়ে বাংলাদেশের জয় বিলম্বিত করেন ‍শুধু। অবশেষে ৪৫তম ওভারে গিয়ে মাশরাফির বলে নাসিরের হাতে দুর্দান্ত এক ক্যাচে পরিণত হন জ্যাক বাল। আদিল রশিদ ৩৩ রানে অপরাজিত থেকে যান। শেষ উইকেটটির পতনের সঙ্গে সঙ্গেই দুর্দান্ত জয়টি এসে গেলো বাংলাদেশের।

অসাধারণ বোলিং করলেন অধিনায়ক মাশরাফি। ৮.৪ ওভার বল করে ২৯ রান দিয়ে ৪ উইকেট নিলেন তিনি। একেবারে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেয়া যাকে বলে। ‍দুর্দান্ত ব্যাটিং এবং দুরন্ত বোলিংয়ের জন্য ম্যাচ সেরার পুরস্কারও উঠলো তার হাতে। জনতার দাবির মুখে শেষ মুহূর্তে দলে নেয়া হয়েছিল নাসির হোসেনকে। জনগণেরই সম্মান রক্ষা করলেন তিনি। ব্যাট হাতে ২৭ বলে অপরাজিত ২৭ রান করার পাশাপাশি বল হাতে পুরো ১০ ওভারে রান দিলেন মাত্র ২৯, ১টি মেডেনসহ উইকেট নিলেন ১টি। ক্যাচ ধরলেন একটি এবং পুরো ম্যাচেই দুর্দান্ত ফিল্ডিং করলেন। তাসকিন ৮ ওভার বল করে ৪৭ রান দিয়ে নিলেন ৩ উইকেট। সাকিব ৯ ওভার বল করে দিলেন ৫০ রান। উইকেট নিলেন ১টি।     মোসাদ্দেক ১ ওভার বল করে উইকেট নিয়েছেন ১টি। শফিউলই শুধু থাকলেন উইকেটশূন্য।

এর আগে জয়ের জন্য ২৩৯ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নামা ইংল্যান্ডকে তবে শুরুতে চেপে ধরার জন্য মাশরাফি বাংলাদেশের বোলিং আক্রমণ শুরু করান স্পিন দিয়ে। সাকিব আল হাসানকে দিয়েই আক্রমণ শুরু করালেন মাশরাফি। অপর প্রান্তে মাশরাফি নিজেই বোলিং ওপেন করলেন এবং নিজের দ্বিতীয় ওভারেই ব্রেক থ্রু এনে দিলেন বাংলাদেশকে। ইনিংসের চতুর্থ ওভারের চতুর্থ বলে জেমস ভিন্স মাশরাফির বলটিতে শট খেলতে গেলেন; কিন্তু ব্যাটের কানায় লেগে ক্যাচ উঠে গেলে ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্ট। মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত ক্যাচটি তালুবন্দী করলেন।

পরের ওভারেই গত ম্যাচে দুর্দান্ত ব্যাট করা বেন ডাকেটকে সরাসরি বোল্ড করে ফেরালেন সাকিব আল হাসান। সাকিবের ইনসুইঙ্গার রক্ষণাত্মক ভঙ্গিতে খেলতে গিয়েছিলেন; কিন্তু ব্যাট ফাঁকি দিয়ে সোজা বলটি আঘাত হানে স্ট্যাম্পে।

মাশরাফি ঝড় থামার কোন লক্ষ্মণ ছিল না। তার সেই ঝড়ে উড়ে গেলেন ইংলিশ ওপেনার জেসন রয় এবং গত ম্যাচে সেঞ্চুরিয়ান বেন স্টোকস। স্টোকসের তো স্ট্যাম্পই উড়িয়ে দিলেন তিনি। ইনিংসের ৮ম ওভারের পঞ্চম বলে জেসন রয়কে লেগ বিফোর আউট করে ফেরালেন মাঠের বাইরে।

এরপরের ওভারের চতুর্থ বলে বেন স্টোকসকে করলেন বোল্ড। গত ম্যাচের সেঞ্চুরিয়ার, আজ ফিরলেন পুরো ডাক মেরে। ২৬ বলে ইংলিশদের পড়লো ৪ উইকেট।

সংক্ষিপ্ত স্কোর:

টস : ইংল্যান্ড (ফিল্ডিং)

বাংলাদেশ : ২৩৮/৮, ৫০ ওভার (মাহমুদউল্লাহ ৭৫, মাশরাফি ৪৪, মোসাদ্দেক ২৯, নাসির ২৭, মুশফিক ২১, তামিম ১৪, ইমরুল ১১; ক্রিস ওকস ২/৪০, আদিল রশিদ ২/৫৩, জ্যাক বাল ২/৪৪, বেন স্টোকস ১/২২)।

ইংল্যান্ড : ২০৪/১০, ৪৪.৪ ওভার (জস বাটলার ৫৭, জনি ব্যারেস্ট ৩৫, আদিল রশিদ ৩৩*, জ্যাক বাল ২৮; মাশরাফি ৪/২৯, তাসকিন ৩/৪৭, মোসাদ্দেক ১/৫, নাসির ১/২৯, সাকিব ১/৫০)।

ফল : বাংলাদেশ ৩৪ রানে জয়ী। ম্যাচ সেরা : মাশরাফি বিন মর্তুজা।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button