মিডিয়া দেশ-বিদেশসংস্কৃতি-বিনোদন

চলছে ঢালি-টলি মসলার রেসিপি

অনলাইন ডেস্ক: আপনি চিত্রনির্মাতা? দামি নির্মাতা না কম দামি? আপনি চিত্রতারকা? দামি না কম দামি? এসবই যেন এখন নির্ধারণ হচ্ছে আপনি কতটা বিদেশমুখী তার ওপর। কোনো তারকাকে প্রশ্ন করলেই দুই প্রশ্নের পর তৃতীয় উত্তরে পাওয়া যায়—‘আমার তো কলকাতায় অনেক অফার। ভাবছি কোনটা করব।’ কোনো চলচ্চিত্রকারকে জিজ্ঞেস করলে বলেন, ‘আমি এবারে একসাথে দুটি জয়েন্ট ভেঞ্চারে ছবি বানাচ্ছি। অনেক তো খুচরো কাজ হলো, এবারে ভালো দরের কিছু করার চেষ্টা করছি।’ কোনো শিল্পী বা মিউজিক ডিরেক্টর বা গীতিকারকে সগর্বে বলতে শুনছি, ‘মুম্বাইয়ের অমুক শিল্পীর সাথে আমার ডুয়েট একটা কাজ হচ্ছে।’ গত কয়েকমাসের  শোবিজ দৃশ্যপটের এই হাল। কলকাতার প্রতিষ্ঠিত কয়েকটি প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানে এখন প্রায় সপ্তাহেই দেখা যায় আমাদের চলচ্চিত্র কুশলীদের। অন্যদিকে প্রায় প্রতিমাসে কয়েকজন শিল্পী, প্রযোজক বা পরিচালকের ভিড় থাকে এখন ঢাকার ফিল্ম পাড়ায়। না তারা কোনো অফিসিয়াল ট্রিপে আসছেন না। স্রেফ ঘুরতে এসে কাস্টিং করছেন, ছবির ব্যবসায়িক আলাপ হয়ে যাচ্ছে!

বোদ্ধা মহলে প্রশ্ন উঠছে, কোনদিকে যাচ্ছি আমরা? দেশের শীর্ষ নায়ক শাকিব খান এখন তার পরবর্তী প্রযোজনার কথা ভাবছেন কলকাতার সাথে। মিডিয়াতেও এক অর্থে ‘এক্সক্লুসিভ’ খবর বলতে বোঝায়, কে কখন ওপার বাংলা বা তারও ওপারে (পড়ুন বলিউড) কার সাথে কাজ করছেন। সম্প্রতি আমাদের দেশের উঠতি গায়ক ইমরান বলিউডের ডেব্যু এক মিউজিক ডিরেক্টর শ্রী প্রীতমের সাথে কাজ করে গর্বিত স্বরে বলছেন বলিউড জয় করে এলেন! অথচ সেই প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের ছবিটিই আদৌ রিলিজ হয় কি না তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। এমনকি সেই মিউজিক ডিরেক্টরের বলিউড ক্যারিয়ারই এখনও নড়বড়ে। এসবই গ্লোবালাইজেশন নামের যুুক্তির জোয়ারে অবশ্যই ইতিবাচক। কিন্তু প্রশ্ন হলো এতে আমাদের ইন্ডাস্ট্রির কতটা উন্নতি হচ্ছে? সামনে প্রযোজক সমিতির নির্বাচন। সেখানেও দুই পক্ষ। একপক্ষের মত, জিতলে ভারতীয় ছবি দেদারসে আনতে দেবো। আরেক পক্ষের মত, আমরা জানপ্রাণ দিয়ে ভারতীয় ছবি ঠেকাবো। সাধারণ এক প্রযোজক কোন পথ নেবে? অনন্য মামুনকে বিভিন্ন প্রচারযন্ত্র এমনকি পরিচালক সমিতিও নিষিদ্ধ করল, অথচ তিনি একাধারে ছবি ও নাম ঘোষণা করেই যাচ্ছেন। সম্প্রতি তিনি কলকাতার উঠতি নায়ককে ঢাকায় এনে ঢাকঢোল পেটালেন। এই আপাত বিজয়দৃশ্য দেখে আমাদের একজন মেধাবী নির্মাতা ভাবতেই পারেন, এখানে তো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই যা খুশি তাই করা যায়! এর উত্তর কে দেবে?
চলচ্চিত্র বোদ্ধা বলে আত্মস্বীকৃত নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী টকশো ও একাধিক পত্রিকায় ভারতীয় ছবির বিরুদ্ধে নিজের একই কথার চর্বিত চর্বণ করছেন অথচ তিনিই আবার কলকাতার অখ্যাত এক চিত্রতারকা সিনা চৌহানকে নিয়ে তার ছবির কাস্ট করেছেন। তাহলে আমরা কোনটা ঠিক বুঝে নেবো? পরিচালক বা চিত্রশিল্পীরা বিভিন্ন টকশোতে নিজের দেশপ্রেমের কথা প্রকাশ করতে গিয়ে বলছেন, ‘আমি আমার দেশের শিডিউল ফাঁসিয়ে ওপার বাংলায় কেন ছবি করব।’ আবার সেই তিনিই ওপার বাংলার প্রসেনজিতের একটি ফোন কল পেয়ে সবকিছু ফেলে ছুট দিচ্ছেন শুটিংয়ে। আমাদের চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মিশা সওদাগরকে এখন ঢালিউডের চেয়ে টলিউডের সেটেই বেশি পাওয়া যাচ্ছে। অবশ্যই এটা তার ব্যক্তিগত ক্যারিয়ারের সাফল্য। কিন্তু আমাদের ঢালিউডের বিশেষ খবর কী? সকলেই সমবণ্টনের কথা বলছেন—দুটি ওপারের ছবি এলে আমাদেরও দুটি ছবি যাবে। কিন্তু বাস্তব দৃশ্য হলো নির্মাতা রেদওয়ান রনি কাঠখড় পুড়িয়েও কলকাতার একটি সিনেমা হলেও তার ‘চোরাবালি’ প্রদর্শন করতে পারলেন না!
এদিকে কলকাতার আনন্দবাজারের সিরিজ রিপোর্টেই প্রকাশ পেয়েছে টলিউডের বাজারের মহামন্দা অবস্থা। সেই রিপোর্টেই তারা প্রকাশ করেছেন টলিউডের বড় বাজেটের ছবি এখন দুই বাংলায় একসাথে ব্যবসা না করলে কোনোভাবেই আর সম্ভব না। স্যাটেলাইট চ্যানেলের সম্প্রচারের কথা তো বাদই দিলাম। গেল ঈদেই ‘পাখি’ কাণ্ড সম্পর্কে তো সবাই জানি আমরা।
আমরা কেউই আটকে থাকার বিপক্ষে নই। কিন্তু দিন শেষে বা বছর শেষের সালতামামিতে আমাদের চলচ্চিত্রের প্রাপ্তিযোগ কতটা হচ্ছে—প্রশ্নটা সেখানেই। ঈদ এলেই এখন অধিকাংশ চ্যানেলের এক্সক্লুসিভ খবর হলো, ওপার বাংলার শিল্পী কে কত বেশি আনতে পারল? যোগ্যতা বা চমক সবই যেন এই ঢালি-টলির ভেতরে। তবে আমাদের মেধাবী শিল্পী আরেফিন শুভ, জয়া আহসান, মম, সুমাইয়া শিমু, তিশা, জাহিদ হাসান তারা কী এখন এক্সক্লুসিভের কাতারে নেই? প্রশ্নটা সেখানেই। কলকাতার বাজারে আমাদের সবচেয়ে জনপ্রিয় ছবিটি কবে দেখব। বা স্যাটেলাইটের আকাশে আমাদের চ্যানেল কবে পাবো? আমরা কেউই জানি না। ওপার বাংলার বাজারে দৈনদশা ঢাকতে এখন বাংলাদেশের বিশাল বাংলাভাষী দর্শকদের বাজার ধরতে হবে এটা ইত্তেফাকের কাছে স্বীকার করলেন স্বয়ং কলকাতার জনপ্রিয় অভিনেতা-প্রযোজক জিত্। এই অবস্থায় আমাদের পরিচালক সমিতি, প্রযোজক সমিতি বা শিল্পী সমিতি কী শুধু টকশো আর মিডিয়াতেই নিজেদের দেশপ্রেমের ডায়লগ আওড়াবেন নাকি কিছু করবেন। ওপার বাংলার মেধাবী নির্মাতা, শিল্পীরা কাজ করছেন এটা সাধারণ দর্শক হিসেবে অবশ্যই আনন্দের বিষয়। কিন্তু সামগ্রিকভাবে সেই কত্ত বছর ধরেই এক শাকিব খান ছাড়া অন্য কারো ছবি আলাদা আকর্ষণ নিয়ে কিনছেন না। বা ছবি রেন্টালও কারো বাড়েনি। এই গোটা অবস্থানে আমাদের চলচ্চিত্রের বিকাশ বলতে তাই ঢালি-টলির জোয়ারের কথায় ঘুরে ফিরে আসছে।
ইমপ্রেস টেলিফিল্মের প্রযোজনায় এর আগে ‘মনের মানুষ’সহ বেশ কিছু ছবি দুই বাংলাতেই প্রদর্শিত ও প্রশংসিত হয়েছে। কিন্তু এর বাইরে কমার্শিয়াল ধারার চলচ্চিত্রগুলো কতটা সুফল বয়ে আনছে, বা তারা আদৌ নিয়ম-নীতি  মেনেই কাজ করছেন তা বোঝা মুশকিল। তাই শুধু টক শো আর মিডিয়ার কাছেই দেশপ্রেমের কথা না বলে আমাদের সাংস্কৃতিক প্রকৃত পথ কোনটা, শিল্পী, নির্মাতারা কোন পথে হাঁটবে তা নির্ধারণ করতে হবে। নয়তো আমাদের অডিও ইন্ডাস্ট্রি, এফডিসি কিংবা অধিকাংশ চ্যানেল ক্রমেই জাদুঘরে পরিণত হতে বাধ্য হবে। খবর- দৈনিক ইত্তেফাক।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button