খেলাধূলা

বাংলাদেশের ঐতিহাসিক জয়

ভালুকা নিউজ: বেন স্টোকসকে বোল্ড করেই সটান দাঁড়িয়ে গেলেন সাকিব আল হাসান। একেবারে মিলিটারি ঢংয়ে- সোজা হও ভঙিতে। কপালে হাত ঠেকিয়ে স্যালুট করলেন। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ঐতিহাসিক এক টেস্ট জয়ের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ। বেন স্টোকস বোল্ড হওয়ার অর্থ বাংলাদেশের জয় নিশ্চিত। সুতরাং, উইকেট পাওয়ার উদযাপনে ভিন্নতা আনতেই পারেন সাকিব। এরপরই একই ওভারে তিনি ফিরিয়ে দিলেন আদিল রশিদ আর জাফর আনসারিকে। বাংলাদেশের ঐতিহাসিক টেস্ট জয় তখন একেবারে হাতের মুঠোয়।
এরপর এক ওভার বিরতি দিয়ে ইংলিশদের পরাজয়ের কফিনে সর্বশেষ পেরেক ঠুকে দিলেন মেহেদী হাসান মিরাজ। স্টিভেন ফিনকে এলবিডব্লিউর ফাঁদে ফেলে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক জয় নিশ্চিত করেন ১৯ বছরের এই তরুণ। বিনা উইকেটে ১০০ থেকে ১৬৪ রানেই অলআউট ইংল্যান্ড। ফলে ঢাকা টেস্টের তৃতীয় দিনেই ১০৮ রানের বিশাল ব্যবধানে ইংল্যান্ডকে প্রথমবারেরমত হারিয়ে ইহিতাস সৃষ্টি করলো বাংলাদেশ।
টেস্ট ক্রিকেটে প্রতিষ্ঠিত কোন শক্তিকে এই প্রথম হারাতে পারলো বাংলাদেশ। এর আগে জিম্বাবুয়ে এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে জিতলেও ওই দল দুটি কোন প্রতিষ্ঠিত শক্তি ছিল না। কারণ, জিম্বাবুয়ে এমনিতেই ভঙ্গুর একটি দল। ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে বাংলাদেশ সিরিজ জিতে আসলেও সেবার জাতীয় দল নামধারী ওয়েস্ট ইন্ডিজের তৃতীয় সারির একটি দল খেলেছিল বাংলাদেশের বিপক্ষে। সেই দলটির অন্তত ১০জনেরই ওই সিরিজের আগে টেস্ট খেলার অভিজ্ঞতা ছিল না।
এর আগে বেশ কয়েকবার জয়ের দ্বারপ্রান্তে গিয়েও জিততে পারেনি বাংলাদেশ। ২০০৩ সালে মুলতানে পাকিস্তানের বিপক্ষে, ২০০৬ সালে ফতুল্লায় অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে, ২০০৮ সালে চট্টগ্রামে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে শেষ মুহূর্তে পরাজিত হতে হয়েছিল বাংলাদেশকে। দুঃখ ভোলার মিশন এবারও ছিল বাংলাদেশের সামনে। সেই চট্টগ্রামে এবারও বঞ্চিত হতে হয়েছিল। তবে, ঢাকায় এসে আর বঞ্চিত হওয়ার সুযোগই দিলো না সাকিব-মিরাজরা। ঐতিহাসিক টেস্ট জয়টি এবার এসেই গেলো। ঢাকায় ইংল্যান্ডকে হারিয়ে সেই ইতিহাস সৃষ্টি করলো বাংলাদেশ।
ঐতিহাসিক টেস্ট জয়টা আসতে পারতো চট্টগ্রামেই। ওই টেস্টে ব্যাটসম্যানরা কিছু ভুল যদি না করতেন, তাহলে নিশ্চিত জিতে যেতো টাইগাররা। তাহলে ইংল্যান্ডের মত দলকে হোয়াইটওয়াশের লজ্জায় ডোবাতে পারতো বাংলাদেশ; কিন্তু সেটা হলো না ২২ রানের পরাজয়ের কারণে।
আলোচনায় ছিল ঢাকা টেস্ট। এখানে কেমন করে বাংলাদেশ- এটাই ছিল চ্যালেঞ্জ। ঢাকা টেস্টের প্রথম থেকেই বাংলাদেশ প্রভাব বিস্তার করে খেলতে থাকে ইংল্যান্ডের ওপর। শুধুমাত্র প্রথম ইনিংসে শেষ দিকে ৪৯ রানে ৯ উইকেট হারিয়ে কিছুটা ব্যাকফুটে চলে যায় বাংলাদেশ। তবে, সেটা কাটিয়ে ওঠে বোলারদের দৃঢ়তায়। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে লিড নেয়ার স্বপ্নও প্রসারিত হচ্ছিল তখন। যদিও শেষ দিকে ইংল্যান্ড ২৪ রানের লিড নিয়ে ফেলেছিল।
সেই লিড টপকে বাংলাদেশ তর তর করে এগিয়ে যেতে থাকে। তামিম-ইমরুলের দুর্দান্ত ব্যাটিংয়ের ওপর ভর করে ঝড়ো সূচনা, এরপর ইমরুল-মাহমুদুল্লাহর দুর্দান্ত জুটি, সাকিব, শুভাগতর মাঝারি মানের ইনিংস- বাংলাদেশকে এনে দিলো ২৭২ রানের লিড। ২৭৩ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে অ্যালিস্টার কুক আর বেন ডাকেট বাংলাদেশকে ধীরে ধীরে জয়ের কক্ষপথ থেকেই সরিয়ে দিচ্ছিল প্রায়।
দু’জন মিলে ১০০ রানের জুটি গড়ার পর তৃতীয় সেশনের প্রথম বলেই উইকেট হারায় ইংলিশরা। বেন ডাকেটকে তুলে নিয়ে প্রথম আঘাতটি হানেন মিরাজ। এরপর তার আক্রমণ অব্যাহতভাবেই চলতে থাকে। টানা তৃতীয় ইনিংসে তুলে নিলেন ৬ উইকেট। এক ম্যাচে নিলেন ১২ উইকেট। সবচেয়ে বড় কথা, এক সেশনেই ১০ উইকেট হারিয়েছে ইংল্যান্ড। যা এর আগে বাংলাদেশের বিপক্ষে আর কখনও ঘটেনি।
এ যেন এক অবিশ্বাস্য টেস্ট। ক্রিকেট যদি হয় রাজকীয় খেলা, তাহলে সেই রাজকীয়তার ধারক-বাহক ইংল্যান্ড। টেস্ট র্যাংকিংয়ে এক সময়ের শীর্ষে থাকা দল। যে দলে রয়েছে টেস্ট র্যাংকিংয়ের এক নম্বর ব্যাটসম্যান। যে দলে রয়েছেন ১০ হাজারেরও বেশি রান তোলা ব্যাটসম্যান। সে দলটির ব্যাটিং গভীরতা ১০ নম্বর পর্যন্ত, তারাই মেহেদী হাসান মিরাজ নামক এক ১৯ বছর বয়সী তরুণের হাতে দিশেহারা হয়ে পড়লো। নাস্তানাবুদ হলো স্পিনারদের ঘূর্ণির সামনে। সাকিব আল হাসান আর মেহেদী হাসান মিরাজ মিলেই ধ্বংস করে দিলেন পুরো ইংলিশ ব্যাটিং লাইনআপ।
অথচ স্বাগতিক বাংলাদেশের দেওয়া ২৭৩ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে শুভ সূচনাই করেছিল ইংল্যান্ড। লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে ইংল্যান্ডের স্কোরশিটে ঠিক ১০০ রান যোগ করেন অ্যালিস্টার কুক ও বেন ডাকেট। এই জুটি ভাঙেন মেহেদী হাসান মিরাজ। ৬৪ বলে ৭টি চার ও একটি ছক্কায় ৫৬ রান করা ডাকেটকে সরাসরি বোল্ড করেন বাংলাদেশের এই স্পিনার। আর কিছু বুঝে ওঠার আগেই জো রুটকে (১) এলবিডব্লিউর ফাঁদে ফেলেন সাকিব।
এরপর গ্যারি ব্যালেন্সকে (৫) তামিম ইকবালের তালুবন্দি করান মিরাজ। মঈন আলিকে রানের খাতা (০) খুলতে দেননি। রিভিউ নিয়েও বাঁচতে পারেননি মঈন। ক্রমশই ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠা আলিস্টার কুককেও (৫৯) ফিরিয়ে দেন মিরাজ। দুর্দান্ত ফর্মে থাকা জনি বেয়ারস্টোকে ৩ রানের বেশি করতে দেননি বাংলাদেশের এই যুবা।
মাঠে নামেন বেন স্টোকস। ইংল্যান্ডের শেষ ভরসা। তার ব্যাটেই ইংল্যান্ডের জয়ের সর্বশেষ স্বপ্ন। ২৫ রান নিয়ে তখনই বাংলাদেশের সামনে আতঙ্ক হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার চেষ্টা করছিলেন তিনি; কিন্তু দলীয় ১৬১ রানের মাথায় সাকিবের বলে সরাসরি বোল্ড। দাঁড়িয়ে স্যালুট করলেন সাকিব। উদযাপনের ভিন্নতাই যেন এই টেস্টকে অন্যমাত্রা এনে দিল। এরপরের বলেই আউট আদিল রশিদ। তৈরি হলো হ্যাটট্রিকের সম্ভাবনা। তবে জাফর আনসারি ঠেকিয়ে দিলেন বলটা। পরের বলেই ইমরুল কায়েসের দারুণ এক ক্যাচে পরিণত হলেন। সর্বশেষ ব্যাক্তি হিসেবে স্টিভেন ফিনকে এলবির ফাঁদে ফেলেন মিরাজ। যদিও শেষ চেষ্টা হিসেবে রিভিউ নেয়ার চেষ্টা করেছিলেন; কিন্তু ইংল্যান্ডের তখন আর রিভিউও বাকি ছিল না। স্ট্যাম্প তুলে তার আগেই উল্লাস শুরু করে বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা।
এর আগে তৃতীয় দিনের শুরুটা ভালোই করেছিলেন ইমরুল আর সাকিব। দুজন মিলে ৪৮ রানে জুটি গড়ে বাংলাদেশকে ২০০ রানের লিড এনে দেয়। তবে এরপরই ঘটে ছন্দপতন। ব্যক্তিগত ৭৮ রান করে মঈন আলির বলে এলবিডব্লিও হয়ে সাজঘরে ফিরে যান ইমরুল।
ইমরুলের বিদায়ের পর সাকিব-মুশফিকের ব্যাটের দিকে তাকিয়ে ছিল টাইগার সমর্থকরা। তবে দুজনই হতাশ করলো। আদিল রশিদের বলে বোল্ড হয়ে সাকিবের (৪১) বিদায়ের পরের ওভারেই স্টোকসের বলে কুককে ক্যাচ দিয়ে সাজঘরে ফিরে গেছেন মুশফিকও (৯)।
এরপর শুভাগত হোমের সঙ্গে ৩০ রানের জুটি গড়ে ব্যক্তিগত ১৫ রান করে আদিল রশিদের দ্রুত গতির সোজা বলে এলবিডব্লিউ হয়ে সাজঘরে ফিরে গেছেন সাব্বির রহমান। মধ্যাহ্ন বিরতি থেকে ফিরে তাইজুল, মিরাজ আর রাব্বিকে সঙ্গে নিয়ে আরও ২৮ রান তোলে শুভাগত। এতে বাংলাদেশের সংগ্রহ দাঁড়ায় ২৯৬। আর ইংলিশদের সামনে টার্গেট দাঁড়ায় ২৭৩ রানের।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button