জাতীয় বিপ্লব ও সংহতির দিন আজ
নিউজ ডেস্ক: দেখতে দেখতে চার দশক পেরিয়ে গেল। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের “স্বাধীনতা দিবস” ও ১৬ ডিসেম্বরের “বিজয় দিবসের” পর বাংলাদেশে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের “জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস” আজ ৪২ বছরে পা রাখল।
৪১ বছর আগের এই দিনে সিপাহি-জনতার মিলিত বিপ্লবে চারদিনের দুঃস্বপ্নের প্রহর শেষ হয়। প্রতিহত হয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ববিরোধী ষড়যন্ত্র। এদিন সিপাহি-জনতা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ক্যান্টনমেন্টের বন্দিদশা থেকে মুক্ত করে আনেন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীনতার স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার মধ্য দিয়ে নেতৃত্বশূন্য রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বশূন্যতার প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগ নেতা খন্দকার মোশতাক আহমদের দুর্বল নেতৃত্ব দিয়ে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব হারানোর ঝুঁকিপূর্ণ দিন পার করছিল বাংলাদেশ।
এর মধ্যেই ৩ নভেম্বর খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে ক্যু সংঘটিত হয়। খন্দকার মোশতাককে ক্ষমতাচ্যুত, তৎকালীন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে বন্দী ও ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয়।
ওই সময় গুজব ছড়িয়ে পড়ে খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে যে অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে তার মদদ দিয়েছে রাশিয়া ও ভারত। এতে সকল সেনা শিবিরসহ সারা দেশেই প্রচণ্ড ভীতি ও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
কিন্তু খালেদ মোশাররফ ছিলেন মুক্তিযু্দ্ধের একজন মহান সেনাপতি ও অবিসংবাদিতভাবে দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদী উপ সেনাপ্রধান। কিন্তু সেনাপ্রধান জিয়াকে গৃহবন্দী করে খালেদ নিজেই সেনাপ্রধান হওয়ায় ও তার স্বজনদের নেতৃত্বে নিহত বঙ্গবন্ধুর পক্ষে মিছিল করার ঘটনায় তার সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে পড়েন সাধারণ সৈনিক ও দেশপ্রেমিক জনতা।
৩ নভেম্বর থেকে ৬ নভেম্বর মধ্যরাত পর্যন্ত দেশে এক শ্বাসরুদ্ধকর অনিশ্চিত অবস্থা বিরাজ করছিল। স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়েছিল। কিন্তু ৬ নভেম্বর দিনগত মধ্যরাতে সিপাহীরা বিদ্রোহ করে এক অসামান্য বিপ্লবের সূচনা করেন।
সৈনিকরা ৭ নভেম্বরের প্রথম প্রহরে বিপ্লব শুরু করেন। তারা সেনা অফিসারদের বাসায় বাসায়, অফিসে অফিসে হামলা শুরু করলেন। তারা অফিসারদের আদেশ অমান্য করার জন্য প্রকাশ্যে মাইকে ঘোষণা দিলেন। অফিসারদের বেশিরভাগই যে যেদিকে পারলেন সেদিকে ছুটে নিরাপত্তা খুঁজলেন।
ঢাকা সেনানিবাসের বিভিন্ন ইউনিট, রেজিমেন্ট বা ব্যাটালিয়ন থেকে সৈনিকরা রাতের অন্ধকারে সেনানিবাসের রাজপথে নেমে এল। তারা এক নাগারে গুলি চালাতে শুরু করেন। জাসদপন্থী সৈনিকদের পাশাপাশি হাজার হাজার সাধারণ সৈনিকও বেরিয়ে পড়ল। অনেক সৈনিক জেনারেল জিয়ার বাসায় গিয়ে তাকে মুক্ত করলেন।
মুক্ত জিয়াকে জাসদপন্থী সৈনিকরা এলিফ্যান্ট রোডে জাসদ নেতাদের কাছে নিয়ে যেতে চান। সাধারণ সৈনিকরা চাইলেন জিয়াকে সেনানিবাসে নিরাপদ জায়গায় রাখতে। জিয়া এলিফ্যান্ট রোডে গেলেন না। জাসদপন্থী এবং সাধারণ সৈনিকরা সেনানিবাসের বিভিন্ন জায়গায় মুখোমুখি হয়ে গেলেন। ওই রাতে বিদ্যুৎবিহীন সেনানিবাসে এক অকল্পনীয় ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ভোর হতেই জিয়া আবার দায়িত্ব নিলেন সেনাবাহিনীর।
ইতিমধ্যে রাত ২টার পরপরই সাধারণ সৈনিকদের একটি বড় দল বঙ্গভবন ঘেরাও করল। বঙ্গভবনে অবস্থানকারী খালেদ মোশাররফ বীর উত্তম ও তার জ্যেষ্ঠ সঙ্গীরা গোপনে বা ছদ্মবেশে বঙ্গভবন ত্যাগ করলেন জীবন বাঁচানোর জন্য। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ, কর্নেল খন্দকার নাজমুল হুদা এবং লে. কর্নেল এটিএম হায়দার এক গাড়িতে দ্রুতগতিতে শেরেবাংলা নগরে অবস্থিত মুক্তিযোদ্ধা দশম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে গিয়ে আশ্রয় নেন।
কিন্তু ব্যাটালিয়নে সৈনিক মহলে রটে গিয়েছিল তারা ভারতপন্থী হওয়ায় জিয়াউর রহমানকে বন্দি করেছিলেন এবং এখন পরাজিত হয়ে পলায়নরত আছেন। কিছুক্ষণ পর তারা তিনজন নিহত হন। তারা তিনজনই অকুতোভয় ও প্রখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন।
এদিকে ঢাকা সেনানিবাস থেকে সৈনিকরা ভোর ৩-৪টার মধ্যেই মহানগরীর রাজপথে ছড়িয়ে পড়ে। সূর্যোদয়ের আগে-পরে হাজার হাজার সাধারণ নাগরিক বাংলাদেশ ও জিয়াউর রহমানের পক্ষে স্লোগান দিতে দিতে সৈনিকদের গাড়িতে উঠে ঢাকার রাজপথ দখল করে রাখে। সৈনিক ও নাগরিকের মধ্যে স্থাপিত বন্ধুত্ব ও সংহতি ছিল অভূতপূর্ব।
১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সম্পর্কে তদানীন্তন দৈনিক বাংলার প্রতিবেদনে বলা হয়—‘সিপাহী ও জনতার মিলিত বিপ্লবে চার দিনের দুঃস্বপ্ন শেষ হয়েছে। মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়েছেন। বৃহস্পতিবার রাত প্রায় ১টায় সশস্ত্র বাহিনীর প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনীর সিপাহী-জওয়ানরা বিপ্লবী অভ্যুত্থান ঘটিয়েছেন। ষড়যন্ত্রের নাগপাশ ছিন্ন করে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে উদ্ধার করেছেন বিপ্লবী সিপাহীরা। ৭ নভেম্বর শুক্রবার ভোরে রেডিওতে ভেসে আসে ‘আমি মেজর জেনারেল জিয়া বলছি’। জেনারেল জিয়া জাতির উদ্দেশে ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে যথাস্থানে নিজ নিজ দায়িত্ব পালনের জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানান। এদিন রাজধানী ঢাকা ছিল মিছিলের নগরী। পথে পথে সিপাহী-জনতা আলিঙ্গন করেছে একে অপরকে। নারায়ে তাকবির আল্লাহু আকবর, বাংলাদেশ জিন্দাবাদ ধ্বনিতে ফেটে পড়ে তারা। সিপাহী-জনতার মিলিত বিপ্লবে ভণ্ডুল হয়ে যায় স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ববিরোধী সব ষড়যন্ত্র। আনন্দে উদ্বেলিত হাজার হাজার মানুষ নেমে আসেন রাজপথে। সাধারণ মানুষ ট্যাংকের গলায় পরিয়ে দেয় ফুলের মালা। এই আনন্দের ঢেউ রাজধানী ছাড়িয়ে দেশের সব শহর-নগর-গ্রামেও পৌঁছে যায়।’
৭ নভেম্বর সম্পর্কে অ্যান্থনি মাসকারেনহাস তার ‘বাংলাদেশ এ লিগ্যাসি অব ব্লাড’ বইতে লেখেন—‘১৯৭৫ সালের ৫ ও ৬ নভেম্বর ক্যান্টনমেন্টসহ সারা শহরে ছড়ানো হলো হাজার হাজার প্রচারপত্র। এই কাজগুলো করল বামপন্থী জাসদ। এ সময় রাজনৈতিক দল জাসদ ছিল নিষিদ্ধ। কিন্তু এরা কাজ করছিল বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা এবং বিপ্লবী গণবাহিনীর আবরণে। একটি ব্যাপারে ডান ও বাম উভয় রাজনৈতিক দলই একমত ছিল। আর তা হচ্ছে, খালেদ মোশাররফ একজন বিশ্বাসঘাতক, ভারতের দালাল এবং সে ঘৃণিত বাকশাল ও মুজিববাদ ফিরিয়ে আনতে চাইছে।’
জাসদ এক ধাপ আরও এগিয়ে গেল। তারা বলল, সিনিয়র অফিসাররা নিজেদের স্বার্থে জওয়ানদের ব্যবহার করছে। সাধারণ মানুষ ও জওয়ানদের ব্যাপারে কোনো মাথাব্যথা নেই। গণজাগরণের ডাক দিয়ে জাসদ ১২টি দাবি পেশ করে। এগুলোর মধ্যে ছিল—ব্যাটম্যান প্রথা বাতিল করতে হবে, অফিসারদের ব্যক্তিগত কাজে সৈন্যদের ব্যবহার করা চলবে না, পোশাক ও পদমর্যাদার ক্ষেত্রে জওয়ান ও অফিসারদের ব্যবধান দূর করতে হবে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে, সব রাজবন্দিকে মুক্তি দিতে হবে। জাসদের দাবিগুলো সে সময়ে তাত্ক্ষণিকভাবে সৈনিকদের সমর্থন আদায়ে সক্ষম হলো।
জাসদের এই দাবিনামা এবং গণঅভ্যুত্থানের ডাক দেয়ার পেছনে যে ব্যক্তিটি কাজ করছিলেন—তিনি হলেন সাবেক আর্মি অফিসার লে. কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) আবু তাহের। তিনিই প্রথম জওয়ানদের মধ্যে ‘ওরা এবং আমরা’ এই ধারণার সৃষ্টি করান এবং অফিসারদের বিরুদ্ধে জওয়ানদের মাথা তুলে দাঁড়াতে সাহায্য করেন।
মধ্যরাতের কিছু পরই অর্থাত্ ৭ নভেম্বরের ভোরের দিকে জওয়ানরা ব্যারাক থেকে বেরিয়ে পড়ল। তারা অস্ত্রাগার থেকে স্টেনগান-রাইফেলসহ অন্যান্য অস্ত্র লুট করল এবং তারা ‘সিপাই-সিপাই ভাই ভাই, অফিসারদের রক্ত চাই’ এবং ‘সিপাই-সিপাই ভাই ভাই, সুবেদারদের ওপরে অফিসার নাই’ ইত্যাদি স্লোগান দিতে দিতে দ্রুত ক্যান্টনমেন্টে ছড়িয়ে পড়ল।
সারা ঢাকা শহরে এই ‘সিপাহি বিপ্লব’ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল। রাত ১টার মধ্যেই সিপাহিরা পুরো ক্যান্টনমেন্ট দখল করে নিল। এদের কেউ কেউ ক্রমাগত ফাঁকা গুলি ছুড়তে লাগল। অন্যরা উত্তেজিত অবস্থায় স্লোগান দিতে দিতে অফিসারদের খুঁজতে লাগল। বেঙ্গল ল্যান্সারের হাবিলদার সারওয়ারের নেতৃত্বে একদল জওয়ান গেল জেনারেল জিয়ার বাসভবনে।
চার দিন বন্দি থাকার পর মুক্তি পেলেন জেনারেল জিয়া। নৈশ পোশাক পরিহিত অবস্থাতেই জিয়াকে উল্লসিত জওয়ানরা কাঁধে করে নিয়ে গেল ২ ফিল্ড আর্টিলারির হেডকোয়ার্টারে। ঘটনার আকস্মিকতায় তখন বিহ্বল হয়ে পড়েছেন জিয়া। নাম না জানা অনেক জওয়ানের সঙ্গে আলিঙ্গন, করমর্দন করলেন তিনি। তাদের কাছ থেকে ছাড়া পেয়ে জিয়া প্রথমেই ফোন করলেন জেনারেল খলিলকে। তাকে বললেন, ‘আমি মুক্ত। আমি ভালো আছি। আমার জন্য কোনো চিন্তা করবেন না।’
জিয়া তার মুক্তিদাতাদের কয়েকজন অফিসারকে তার কাছে নিয়ে আসতে বললেন। তারা হচ্ছেন জেনারেল মীর শওকত আলী, জেনারেল আবদুর রহমান এবং কর্নেল আমিনুল হক। সৈন্যরা যখন তাদের নিয়ে এলো, তখন তিনি তাদের প্রত্যেকের সঙ্গে কোলাকুলি করলেন। সৈন্যদের নিয়ন্ত্রণ করতে তিনি তাদের সহযোগিতা চাইলেন। বললেন, ‘আমি রক্তপাত চাই না।’
বাংলাদেশ এ লিগ্যাসি অব ব্লাড-এ আরও বলা হয়েছে, রাত দেড়টার দিকে জওয়ানরা রেডিও স্টেশন দখল করে নিল। তারা রাতের কর্মীদের জানাল যে, জেনারেল জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে সিপাহি-জনতার বিপ্লব শুরু হয়ে গেছে। বিস্মিত রেডিওর কর্মকর্তারা প্রথমে বুঝে উঠতে পারলেন না তারা কী করবেন। যখন তারা টের পেলেন যে, জওয়ানরা তাদের ভয় দেখাচ্ছে না এবং খালেদ মোশাররফ পরাজয়বরণ করেছেন; তখন তারা সবাই উল্লসিত সৈন্যদের সঙ্গে যোগ দিলেন। সৈন্য এবং সাধারণ মানুষ ভর্তি কিছু ল্যান্সার ট্যাঙ্ক শহরের মাঝখানে এসে পৌঁছল। ক্যান্টনমেন্টে গোলাগুলির শব্দ শুনে প্রথমে লোকজন ভয় পেয়ে গিয়েছিল। কিন্তু রেডিওতে ক্রমাগত ‘সিপাহি বিপ্লবের’ ঘোষণা এবং জেনারেল জিয়ার ক্ষমতা দখলের খবর শুনে হাজার হাজার লোক স্রোতের মতো রাস্তায় নেমে এলো। তিন দিন ধরে তারা বিশ্বাস করছিল যে, ভারত খালেদ মোশাররফের মাধ্যমে তাদের কষ্টে অর্জিত স্বাধীনতাকে বিপন্ন করছে। এখন সেই দুঃস্বপ্ন কেটে গেছে। সর্বত্র জওয়ান এবং সাধারণ মানুষ খুশিতে একে অপরের সঙ্গে কোলাকুলি করল, রাস্তায় নামল। সারারাত তারা স্লোগান দিল, ‘আল্লাহু আকবার, বাংলাদেশ জিন্দাবাদ, সিপাহি বিপ্লব জিন্দাবাদ’। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছিল, ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের মতো এদেশের মানুষ আবার জেগে উঠেছে। এটা ছিল একটি স্মরণীয় রাত।
রেডিও বাংলাদেশে এক সংক্ষিপ্ত ভাষণে জেনারেল জিয়াউর রহমান ঘোষণা করেন, তিনি সাময়িকভাবে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন। সেনাবাহিনীর অনুরোধে এবং দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে বাধ্য হয়েই তিনি এ দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। তিনি বলেন, সাধ্য অনুযায়ী তিনি তার কর্তব্য পালন করবেন। দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তিনি সবাইকে ঐক্যবদ্ধ এবং কঠোর পরিশ্রম করার আহ্বান জানান। তিনি অবিলম্বে সবাইকে কাজে যোগ দেয়ারও নির্দেশ দেন।