জাতীয়প্রাণের বাংলাদেশবিভিন্ন দিবস

আজ সেই ভয়াবহ ১২ নভেম্বর

অনলাইন ডেস্ক: আজ সেই ভয়াল ১২ নভেম্বর। ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর ভোলা চট্টগ্রাম নোয়াখালী লক্ষ্মীপুর পটুয়াখালী সহ দেশের উপকূলীয় এলাকায় আঘাত হেনেছিল ভয়াল এক গোর্কি। এর আঘাতে প্রাণ হারিয়েছিল ভোলাসহ উপকূলীয় অঞ্চলের প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ। সেই দিনটির কথা মনে পড়লে আজো আঁতকে ওঠে এ অঞ্চলের মানুষ। ঘটনার এতদিন পরও জলোচ্ছ্বাস আতঙ্ক তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে উপকূলবাসীকে।

৪৬ বছর আগের এই দিনে এক রাতের ব্যবধানে ভোলার চার ভাগের একভাগ মানুষ নিমিষে নিঃশেষ হয়ে যায়। মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয় এখানকার বিস্তীর্ণ জনপদ। সাগর পাড়ের মনপুরা, কুকরী-মুকরী ঢালচরসহ ছোট ছোট দ্বীপচর এবং নদী তীরবর্তী এলাকাগুলোর বেশিরভাগ মানুষই প্রাণ হারায়। এমনকি ভোলা শহরও গোর্কির ভয়াল ছোবল থেকে রক্ষা পায়নি।

প্রায় দেড়শ মাইল বেগের গতি সম্পন্ন ঘূর্ণিঝড় ও ২০-২৫ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাসে মৃত্যুকূপে পরিণত হয় গোটা উপকূল। সেদিনের দুঃসহ স্মৃতি এখনো কাঁদিয়ে তোলে উপকূলবাসীকে। ভয়াবহ এই দুর্যোগের তিন যুগ অতিবাহিত হলেও এখনো রাষ্ট্রীয় কোনো স্বীকৃতি মেলেনি। এ দিনটিকে উপকূল দিবস হিসেবে পালনের দাবি দীর্ঘদিনের।

তখন পত্রিকার শীর্ষ সংবাদ শিরোনাম হয়েছিল ‘ভোলার গাছে গাছে ঝুলছে লাশ’। গোটা এলাকা পরিণত হয়েছিল মানুষ আর গবাদিপশু’র লাশের স্তূপে। পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ ছিল যে, মা তার প্রিয় সন্তানকে মৃত্যুর কোলে ঠেলে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। সত্তরের সেই বিষাদ আর যন্ত্রণাময় স্মৃতি নিয়ে এখনো দিন কাটছে গোর্কির মুখ থেকে বেচে আসা মানুষগুলো।

সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে হাতিয়ার বয়ারচরের সত্তোর্ধ্ব ইয়াকুব আলী বলেন, সেই দিনটি ছিল রমজান মাসের কোনো এক বৃহস্পতিবার। সকাল থেকেই গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি ঝরছিল। বিকেলের দিকে বাতাসের বেগ বাড়ে। রমজান মাস হওয়ায় গ্রামের অধিকাংশ মানুষ সন্ধ্যার সঙ্গেই রাতের খাবার সেরে ভোররাতে তাড়াতাড়ি উঠার জন্য ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু রাতের দিকে রেডিওতে খবর আসে উপকূলে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত। দিনভর কোনো সংকেত পাওয়া যায়নি। ঘুমন্ত মানুষের ওপর দিয়ে বয়ে যায় প্রাকৃতির ভয়াবহ হিংস্র থাবা। ঘুমের মধ্যেই জোয়ারের পানিতে ভেসে যায় উপকূলের হাজার হাজার মানুষ।

সেদিন বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপটি হারিকেনে রূপ ধারণ করে। যার প্রভাবে উপকূলীয় এলাকায় ২০-২৫ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, উপকূলবাসীর অধিকাংশ মানুষই এ সতর্কবাণী জানতে পারেনি। ঘুমন্ত মানুষের ওপর গভীর রাতে সর্বশক্তি নিয়ে আঘাত হানে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস ‘গোর্কি’।

মুহূর্তেই ঘর-বাড়ি, স্কুল-কলেজ, গাছ-পালা, গবাদিপশু, ফসলের মাঠ ও রাস্ত-ঘাট ভেঙে সমতলে পরিণত হয়। জলোচ্ছ্বাসের ফলে ভেসে যায় হাজার হাজার মানুষ। লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় উপকূলীয় এলাকার জনপদ। সেদিন শেষ রাতের দিকে প্রকৃতি শান্ত হয়ে আসে। কমতে থাকে জলোচ্ছ্বাসের পানি। কিন্তু থেকে যায় স্বজনহারাদের কান্না, আহাজারি আর হাহাকার। চারদিক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে লাশ আর লাশ। বাতাসে লাশের গন্ধ আর স্বজনদের আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে পুরো উপকূলের বাতাস।

বয়ে যাওয়া সেই দুঃসহ স্মৃতির কথা এখনো ভুলতে পারছেন না উপকূলবাসী। আকাশে সামান্য মেঘ দেখলেই ভয়ে আতঙ্কে থাকেন তারা। চন্দ্র-সূর্য হিসাব নিকাশ আর ধারণার ওপর নির্ভর করেই ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের পূর্বাভাস জানার চেষ্টা করেন তারা। এ জনপদের মানুষ এখনো আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারেননি। তাছাড়া আগের মতো সে ব্যবস্থাও নেই তাদের।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, উপকূলে যে পরিমাণ মানুষ তার মধ্যে ৫ শতাংশ মানুষের জন্য রয়েছ আশ্রয় কেন্দ্রের ব্যবস্থা। তাছাড়া যে কয়টি রয়েছে সেগুলোর নেই দরজা জানালা। আবার এগুলোতে যাতায়াতের ভালো ব্যবস্থাও নেই। তাই বন্যার সম্ভাবনা দেখলে কন্টেইনার, খালি কলস কিংবা শুকনো নারিকেলেই ভরসা উপকূলবাসীর।

এ বিষয়ে উপকূল বাঁচাও আন্দোলনের উপদেষ্টা মশিউর রহমান রুবেল বলেন, ‘দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা পেতে সবাইকে আরো বেশি সচেতন হতে হবে। সচেতনতাই দিতে পারে ক্ষয়ক্ষতি থেকে মুক্তি। এতে যেমন উপকূলবাসীর দায়িত্ব রয়েছে তার চেয়ে বেশি দায়িত্ব সরকারের।’ দুর্যোগ সচেতনা বৃদ্ধির লক্ষে ১২ নভেম্বরকে দুর্যোগ দিবস হিসেবে পালন করার দাবিও জানান উপকূল বাঁচাও আন্দোলনের এই কর্মী।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button