পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রা বিশ্ব হেরিটেজ
অনলাইন ডেস্ক: এবার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করল মঙ্গল শোভাযাত্রা। বাংলাদেশের অনন্য সাধারণ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রাকে ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজের মর্যাদা দিয়েছে ইউনেস্কো। বুধবার বিকেলে ইথিওপিয়া থেকে এই অর্জনের খবর পৌঁছে।
বিশ্বের নানা দেশে ছড়িয়ে আছে ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজের অসংখ্য উপাদান। ওইসব দেশের আবেদনের প্রেক্ষিতে এসব উপাদান যাচাই-বাছাই ও সুনির্দিষ্ট করে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে তুলে ধরার কাজ করে ইউনেস্কো। আন্তর্জাতিক সংস্থাটির স্বীকৃতি লাভের মধ্য দিয়ে একটি দেশ ওই উপাদানের আঁতুড়ঘর হিসেবে বিশ্ব দরবারে সুপ্রতিষ্ঠি হয়। মর্যাদা লাভ করে। সনদে স্বাক্ষর করা সব দেশ প্রতি বছর নিজেদের যে কোন একটি উপাদানের স্বীকৃতি চেয়ে ইউনেস্কোতে আবেদন করতে পারে। এ বছর বাংলাদেশ ঐতিহ্যবাহী মঙ্গল শোভাযাত্রার স্বীকৃতি চায় বাংলাদেশ। ‘পহেলা বৈশাখে মঙ্গল শোভাযাত্রা’ শিরোনামে ফাইল প্রেরণ করে। কয়েক ধাপ পর্যালোচনা শেষে বুধবার স্বীকৃতির কথা জানায় আন্তর্জাতিক সংস্থাটি।
স্বীকৃতি দানের মূল কাজটি করে ইন্টারগবর্নমেন্টাল কমিটি ফর দ্য সেফগার্ডিং অব দ্য ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ। কমিটির একাদশ সম্মেলন গত ২৮ নবেম্বর থেকে ইথিপিয়ায় শুরু হয়েছে। সম্মেলনে বাংলাদেশের পক্ষে যোগ দিয়েছেন ঢাবির চারুকলা অনুষদের ডিন নিসার হোসেন। সেখান থেকে মোবাইল ফোনে তিনি জনকণ্ঠকে জানান, বাংলাদেশ সময় দুপুর বারোটায় কমিটিতে উপস্থাপিত হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। ফাইলের পক্ষে বক্তব্য তুলে ধরেন ইউনেস্কোতে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি এম শহীদুল ইসলাম। বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা শেষে কমিটি তাদের সন্তুষ্টির কথা জানায়। মঙ্গল শোভাযাত্রাকে ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ হিসেবে স্বীকৃতি দেয় তারা। এর ফলে মঙ্গল শোভাযাত্রা আর কেবল বাংলাদেশের হয়ে থাকল না, বিশ্বের মনোগত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উপাদান হিসেবে বিশেষ মর্যাদায় আসীন হলো।
জানা যায়, তারও আগে নমিনেশন ফাইলে করা প্রাথমিক আবেদনের যৌক্তিকতা যাচাই-বাছাইয়ের কাজ করে ইউনেস্কোর একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি। ৬টি দেশের ছয়জন প্রখ্যাত আইসিএইচ বিশেষজ্ঞ দ্বারা গঠিত হয় সাবসিডিয়ারি বডি। বডি এক বছর ধরে বিভিন্ন দেশের মনোনয়ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তাঁদের অভিমত ২৪-সদস্যবিশিষ্ট মূল কমিটির বিবেচনার জন্য ইউনেস্কোর ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে। ওয়েব সাইটের তথ্য অনুযায়ী, পাঁচ ক্যাটাগরির চারটিতে শতভাগ নম্বর পায় মঙ্গল শোভাযাত্রা। এরপর থেকে এটি প্রাথমিক তালিকায় ছিল।
ইউনেস্কোর স্বীকৃতি লাভের জন্য উপাদানের পক্ষে নির্ভুল নমিনেশন ফাইল প্রস্তুত করা খুব জরুরী। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় বাংলা একাডেমিকে ফাইলটি তৈরির দায়িত্ব দেয়। একাডেমির পক্ষে ফাইল তৈরির কাজ করেন এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ড. ফিরোজ মাহমুদ। আলোকাচিত্র ও ভিডিও চিত্রের কাজ করেন একাডেমির কর্মকর্তা মুর্শিদ আনোয়ার। জনকণ্ঠকে ড. ফিরোজ মাহমুদ বলেন, মঙ্গল শোভাযাত্রা আমাদের বর্ষবরণ উৎসবের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ।
সেদিক থেকে দেখলে উপাদানটি ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পাওয়ার যোগ্য। তবে ইউনেস্কার নিয়ম ও শর্তগুলো বুঝে, যথাযথভাবে অনুসরণ করে ফাইল তৈরি করতে হয়। আমরা সেসব বিষয়ে সজাগ ছিলাম। সিরিয়াসলি কাজ করেছি। ফলে আমাদের বক্তব্য ইউনেস্কোর কাছে বোধগম্য হয়েছে। ফাইলের প্রশংসা হয়েছে সংস্থার ওয়েব সাইটে। আমাদের জন্য তো বটেই, বাংলাদেশের জন্য এটা অনেক বড় আনন্দের খবর।
মঙ্গল শোভাযাত্রার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিতে সবচেয়ে বেশি উচ্ছ্বসিত সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, বাংলাদেশ শুধু অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে না, বাংলাদেশ সমৃদ্ধ সংস্কৃতির দেশ। গর্ব করার মতো অনেক কিছু আছে আমাদের। বিশ্বদরবারে সেগুলোর কথা তুলে ধরার চেষ্টা করছে সরকার। মঙ্গল শোভাযাত্রার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি তার প্রমাণ। দেশ অর্থনৈতিকভাবে যেমন এগিয়ে যাচ্ছে, তেমনি এগিয়ে যাচ্ছে সাংস্কৃতিকভাবে। আরও অনেক অর্জনের জন্য সরকার কাজ করছে বলে জানান তিনি।
প্রসঙ্গত, মানবজাতির উল্লেখযোগ্য মনোগত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণের প্রয়োজনে ২০০৩ সালে ইউনেস্কো একটি সমঝোতা চুক্তি অনুমোদন করে। এই সমঝোতা চুক্তির অধীনে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মনোগত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হয়। ২০১৬ সাল পর্যন্ত ১৭১টি রাষ্ট্র এই সমঝোতা চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। ২০০৯ সালের ১১ জুন চুক্তিতে স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ। ২০১২ সাল থেকে সরকারের পক্ষে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় মানবজাতির মনোগত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতিনিধিত্বমূলক তালিকায় অন্তর্ভুক্তির জন্য উপাদান পাঠানো শুরু করে। ইউনেস্কোর প্রথম স্বীকৃতি লাভ করে বাংলাদেশের বাউল সঙ্গীত। পরবর্তীতে ২০১৩ সালে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী জামদানি বুননশিল্প লাভ করে এই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। কিন্তু গত তিন বছর অর্জন ছিল শূন্য। গত বছর দুর্বল নমিনেশন ফাইলের কারণে ব্যর্থ হয় বাংলাদেশের মৌলিক সংস্কৃতির উপাদান যাত্রাপালা। একই কারণে ২০১২ সালে ‘ঐতিহ্যবাহী নকশীকাঁথা সুচিশিল্প’ স্বীকৃতি লাভ করতে পারেনি। মঙ্গল শোভাযাত্রা তিন বছরের ব্যর্থতা পেছনে ফেলে সাফল্যের মুখ দেখাল।