সাহিত্য সংবাদ

কবি ও সাংবাদিক শেখ সামুসল হক : প্রেম বিপ্লব ও বিজ্ঞান কবি

 

স্মৃতির আলোকে
– আনম আবদুস সোবহান

শেখ সামসুল হক কবি, সাংবাদিক, গবেষক ও সংগঠক। প্রত্যেক েেত্রই তাঁর অবদান উল্লেখযোগ্য। সৃজনশীল কাজ ব্যাহত হয় সাংগঠনিক কাজে। তবু এ েেত্রও সামাজিক দায়িত্ববোধ থেকে পদচারণা করতে হয়। এই ত্যাগ স্বীকার অবশ্যই প্রশংসনীয়। এই নানামুখী ভূমিকায় সে-ই অধিক সফল যে সময়কে ভাগ করে বা অবিরাম যুক্ত থাকে কার্য পরিক্রমায়। এসব বিবেচনায় বলা যায় শেখ সামসুল হকের সাফল্য সমান্তরাল না। তিনি উচু, মাঝারি ও নীচু পিরামিডের স্রষ্টা। ইতিহাসের আলোকে তাঁর সামগ্রিক কার্যক্রমের যোগফল অবশ্যই গৌরবের এ মন্তব্য করা যেতেই পারে। সে ১৯৭৯ সালের কথা আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে প্রচেষ্টায় মুখ্য ভূমিকায় ছিল পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন, ঢাকা প্রেস কাবের সামনে থেকে পুলিশের সঙ্গে এক সংঘর্ষে আহত হয় আমার সহপাঠি তৈয়বা বেগম। আমি শিল্পী এম মহিউদ্দিনকে নিয়ে ইকবাল হলে ফিরে যাই। সে রাতেই গ্রেফতার হন রাশেদ খান মেনন, আবদুস সামাদ। অচিন্ত্য কুমার সেনগুপ্ত সহ ৪ জন। এরপর প্রত্যাবর্তন করি নিজ জেলা ফরিদপুর শহরে। সেখানে যুক্ত হয়ে পড়ি আন্দোলনে। আসাদ ভাই যেদিন ঢাকায় শহীদ হন; সেদিন আমি ছাত্র ইউনিয়নের ফরিদপুর শাখার অফিস উদ্বোধন করি অনাথের মোড়ে। উদ্বোধনের একটু পরেই সংবাদ পাই আসাদ ভাইয়ের শহীদ হবার কথা। আল্টিমেট মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে আইয়ুবের পতন হয়। দেশে সামরিক আইন। ইয়াহিয়া খান মতায় আসীন। এ সময়ে উদ্যোগী হয়ে প্রতিষ্ঠা করি ‘ফরিদপুর সাহিত্য ও সংস্কৃতি উন্নয়ন সংস্থা (২০ জুলাই ১৯৬৯)। প্রস্তুতি হিসেবে পূর্বে ৮ জুনও ২৩ জুন দুটো সাহিত্য সভা করি ফরিদপুরে। এভাবে লেখক, সাংবাদিক, শিল্পী, শিকদের একত্রিত করি। এ প্রতিষ্ঠান বিষয়ে আলোচনায় অনেকে নিষেধ করে বলে- এখন এসব করার সময় না। আমার আহবানে সর্বাগ্রে সাড়া দেয়-আমার সহপাঠি আজম আমীর আলী, চিত্তরঞ্জন পাল, সুফী আবদুল্লাহ আল মামুন, যুক্ত হয় কবি ফরিদপুর পোস্ট অফিসের পোস্ট মাস্টার আহমদ আলী মুন্সী (একজন লেখক- বানী, ময়মনসিংহ)। এ সময়ে একঝাঁক তরুণ যুক্ত হয় এই কার্যক্রমে। এই তরুণদের মধ্যে ছিলেন কবি শেখ সামসুল হক। অন্যান্যের মধ্যে যুক্ত হয় মিহির কর্মকার (বার্তা সম্পাদক-দৈনিক সংবাদ), আতাহার খান (কবি, সাংবাদিক), আলমগীর হোসেন বাচ্চু (সাংবাদিক), খায়রুল আনোয়ার মুকুল (বার্তা সম্পাদক, এনটিভি) প্রমুখ। আমার চেয়ে অপোকৃত তরুণদের প্রধান ছিল শেখ সামসুল হক। এই সংস্থা থেকে আলাওল পুরস্কারের প্রস্তাবক ছিলেন আজকের অনুপ্রাসের এই শেখ সামসুল হক। যে পুরস্কার যে পুরস্কার সে সময়ে অত্যন্ত আদৃত হয়েছিল। এই সংস্থার উদ্যোগে ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পরে বিুদ্ধ শিল্পী গোষ্ঠীর ব্যানারে অসহযোগ আন্দোলনে অংশ নেয়া হয়। অতপর স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রত্যভাবে যুক্ত হয় আতাহার হোসেন খান, মিহির কর্মকার সহ অনেকে। শেখ সামসুল হক মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে শহরে অবস্থানরত সমর্থকদের মধ্যে যোগাযোগের দায়িত্ব পালন করে। স্বাধীনতার পূর্বেই গ্রেফতার ও নির্যাতনের শিকার হয়।

১৯৭২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারীতে (স্বাধীন দেশ প্রথম ২১ ফেব্রুয়ারী) শেখ সামসুল হকের উদ্যোগে ফরিদপুর থেকে প্রকাশিত হয় গণ কবিতার সংকলন (কবির সংখ্যার পর আনম আবদুস সোবহান, হাবীবুল্লাহ সিরাজী, এস এম সামসুল হক ও আতাহার হোসেন খান) ‘শব্দের আকাঙ্খায় সূর্য’। স্বাধীনতা উত্তর কালে ফরিদপুর থেকে মিহির কর্মকারের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় প্রথম সাপ্তাহিক সংবাদ পত্র ‘সাপ্তাহিক যুবশক্তি’ এতে সরাসরি যুক্ত ছিলেন এস এম সামসুল হক (শেখ সামসুল হক)। আতাহার খান এই পত্রিকার সূচনা করে। এভাবেই এস এম সামসুল হকের উত্থান। কবি, সংগঠক, মুক্তিযোদ্ধা ও সাংবাদিক হিসাবে। এই প্রাণবন্ত তরুণ একাই অনেক কাজ করতো। কবিতা লেখা, সংবাদ, ফিচার লেখা; সবাইকে সংগঠিত করা। অনেক পরে তারই উদ্যোগে ফরিদপুরে লেখক শিবিবের শাখা করা হয়েছিল। এতে আমাকে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নিতে হয়েছিল। সাংগঠনিক দায়িত্বে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল আমারই ছাত্র মিনার মাহমুদ। সে সময়ে শেখ সামসুল হক ঢাকায় অবস্থান করতো।

সম্পাদক ও সাংবাদিক হিসাবে কাজ করেছে নানা পর্যায়ে। সাপ্তাহিক যুবশক্তি (ফরিদপুর), মাসিক গণমন (ফরিদপুর), দীপ্ত বাংলা (মাসিক, ঢাকা), অগ্রদূত (নির্বাহী সম্পাদক, মুখপত্র স্কাউট এসোসিয়েশন), দৈনিক আমাদের কথা (ঢাকা), দৈনিক নব অভিযান ইত্যাদি। ফরিদপুরের ইতিহাস ও লোক সাহিত্য বিষয়ে অনেক দৃষ্টিগ্রাহ্য প্রবন্ধ রচনা করেছে। ‘ফরিদপুরে লোক সাহিত্যের উপর সেই প্রথম পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ রচনা করে (আশ্বিন, ১৩৯০)। এস এম সামসুল হকের পরে এসে গবেষণায় উদ্যোগী হয় মাসুদ রেজা, খলিলুল্লাহ দিলদারাজ, ফারুক-ই-আজম সহ অনেকে। মূলত শেখ সামসুল হক এেেত্র পথিকৃৎ।
নানা প্রবনতার কারনে প্রতিষ্ঠা করেছিল ঢাকা থেকে ‘লেখক’ নামে সাহিত্য পত্রিকা ও লেখক প্রকাশনী। প্রতিশ্রুতিশীল নবীন লেখকদের গ্রন্থ প্রকাশের ব্যবস্থা করা। গ্রন্থ মেলায় স্টল। সে কি উৎসাহ-উদ্দীপনা। কিন্তু এ প্রকাশনা ধরে রাখতে পারেনি। গ্রন্থ সমালোচনায় তার উৎসাহের অন্ত ছিলনা। ফলে অনেক প্রখ্যাত পুরস্কার প্রাপ্ত লেখকও তার সঙ্গে যোগাযোগের জন্য ছুটে যেতেন তার ‘অগ্রদূত’ অফিসে। অনেক কবি, গল্পকারের প্রথম বই প্রকাশের ব্যবস্থা করেন শেখ সামসুল হক। অতপর থিতু হয় অনুপ্রাস সংগঠনে…। এই অনুপ্রাসই বর্তমান তার প্রধান ঠিকানা। এই অনুপ্রাস করে তাকে ত্যাগ করতে হয়েছে সৃজনশীল কর্মকান্ড। তাই বিরল প্রজনন লেখক সে। একজন সংগঠক হিসেবে তার তুলনা নেই। অনুপ্রাসের আর এক নাম শেখ সামসুল হক। ‘প্রগতিতে মুক্তি’ এই বিশ্বাসে সে বিশ্বাসী। সে আমার স্নেহভাজন-আপনজন-অতি কাছের মানুষ। তার প্রতি আমার অনেক শুভেচ্ছা।

অধ্যাপক ও কবি

কবির কবিতায় বিপ্লবী ভাষা ও দেশাত্ববোধ
– রীনা তালুকদার

পৃথিবীর জন্ম লগ্ন থেকেই যুদ্ধ মানুষের দৈহিক ও আত্মিক সঙ্গী। প্রেমের যুদ্ধ, ধর্মযুদ্ধ, গোলাপের যুদ্ধ, মসলার যুদ্ধ, বছরের পর বছর যুদ্ধ, সমস্যায় যুদ্ধ, সমাধানে যুদ্ধ, সভ্যতার সংঘাত সমাধান সভ্যতার শুরু থেকেই চলমান। সব যুদ্ধেই অগণিত প্রাণহানি আর সম্পদের ঢালাও অপচয় মানুষের বিবেককে সাময়িকভাবে ঝাঁকুনি দিলেও অল্পতেই মানুষ ভুলে যায় এবং নতুন করে জড়িয়ে যায় নতুন কোনো যুদ্ধে। বিংশ শতাব্দীতে পৃথিবীজুড়ে তান্ডব-য়তির দিক থেকে দুটি বিশ্বযুদ্ধ থেকেও মানুষ এমন কোনো শিাই মনে রেখে কাজে লাগায়নি। এজন্য সর্বগ্রাসী দুটি বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতি মানুষের মন থেকে না মুছতেই আবারো শুরু হয়েছিল অন্য এক যুদ্ধ। যা বিশ্বের অস্তিত্বকে করেছে আশংকাজনক। এই বিশ্বে বিবিধ বিষয়ে সব গুলো রাষ্ট্রই বিভিন্ন যুদ্ধে লিপ্ত। মানুষের জন্য দ’ুবেলা অন্নের সংস্থান করতে না পারা দেশও তৈরী করছে অস্ত্র ভান্ডার। মানুষের আচরণই যুদ্ধাংদেহী। স্নায়ুযুদ্ধের অবসান হয়নি এখনো। বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক সংকটের মূল কারণই যুদ্ধ। সবরকম যুদ্ধের হিসাব-নিকাশের পেছনে আছে অন্যের সম্পদের ভাগ বাটোয়ারা। আছে অর্থনৈতিক লাভ-তির সুনির্দিষ্ট হিসাব-নিকাশ। আর কবি বলেছেন-

অভাবের গা ছুঁয়ে বলছি সুখে আছি
বাজারের আগুন দেখতে ভালোবাসি
আগুনের ভালোবাসা নয় কানামাছি
খেলা দেখে কখনো হাঁটছি পাশাপাশি
……………………………………
অভাবের টিকানা দিয়ে কি হবে আজ
——————————-
অভাবের পা ছুঁয়ে বলছি আর নয়
অতীতের অকাল বৈশাখ রজনীর
অনিকেত একদা আরার পরাজয়
কাছে টেনে বারুদ বিভাস স্বজনীর। (চমৎকার সাহস-কাপুরুষের উক্তি)

মানুষে মানুষে বৈষম্যের সমাজে বাড়ছে দূরত্ব। অর্থনীতির পতনমুখী ধারার সাথে সমন্বিত সমস্যাবলির কারণে বেকার জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়া, বড় শহরগুলোতে গৃহহীন মানুষের বাক্স-বাড়ি সহজেই ছবি চিত্র এবং বেতন কাঠামোয় স্থিতাবস্থা, খন্ডকালীন সময়ের কর্মীদের উপর বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের ব্যাপক নির্ভরতা, সামাজিক অবয়ের নানামুখী চিত্র ক্রমশ: দৃশ্যমান হচ্ছে। পৃথিবী ক্রমেই বিভিন্ন বিপন্ন সংকটের দিকে ধাবিত হচ্ছে। বায়বীয় শত্রুর সাথেই সবাই যুদ্ধ করে যাচ্ছে নিয়ত। সবাই মনে করছে আমার শত্রু আছে। ফলে মানুষের মধ্যে দেশপ্রেমীর মন বদলে যাচ্ছে। মানুষ হয়ে যাচ্ছে চেনা ছবি থেকে অন্যরকম মানুষ, অচেনা মানুষ। জনগণ না পাবার অধিকার পেতে প্রতিবাদ জানাতে রাজপথে নামলে ঠেকায় কে। আর কবির কবিতা সেখানে সোচ্চার ােভ প্রকাশের প্রতিবাদ-সমাবেশের তীর্থভূমি। এই সকল প্রতিবাদে কবিতা এক তরুণ যোদ্ধা হিসাবে কাজ করে যায়। কবিতার সুক্ষ্ম মতা যা কয়েক হাজার মানুষকে যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিতে পারে অনায়াসে। কবির কবিতায়ই পারে আবার যুদ্ধ থেকে ফিরিয়েও আনতে।
তৎকালীন পাকিস্তানে সাথে অসংখ্য লোকের প্রাণহানির বিনিময়ে বাংলাদেশের বিজয় অর্জন করা সম্ভব হয়েছিল, ভয়াবহ যুদ্ধের বেদনাদায়ক সেদিকটি সাফল্যের ডামাডোলে ঢাকা পড়ে এখন অনেকটা যেন ‘দেশপ্রেমিক যুদ্ধ’ হিসাবে দেখা হচ্ছে। অথচ জাতিসত্তার এই যুদ্ধে অনেক আপনজন হারিয়ে গেছে। অনেক আপনজন হয়ে গেছে আজীবন পর। অনেকেই ভিন্ন প অবলম্বন করছে। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিপ্লবের গ্লানি বিশ্বের সব সাহিত্যের মধ্যে প্রভাব ফেলেছে যা বিশ্বের বিভিন্ন সাহিত্যের ইতিহাস প্রমাণিত। স্পেনের যুদ্ধের সময়ে রচিত বহু কবিতার জন্য বিখ্যাত হয়ে আছে বহু কবি। আবার যুদ্ধ পরবর্তীতেও কবিতায় যুদ্ধের রেশ বহু বছর জীবন্ত ছিল। যেমন-কবি লুই পেরেজ ইনফান্তি, হুয়ান রামন হিমেনেথ, লেওন ফেলিপ, জোসে মোরেনো ভিলা, ফেরেরিকো গার্থিয়া লোরকা, মিগুয়েল হেরনান্দেজ, এমিলিও প্রাদোস্, ভিসেন্ত আলেকজান্ডার, রাফায়েল আলবের্তি, লুই থের্নুদা, গাব্রিয়েল কেয়া, দিওনিসিও রিদরুয়েজো, রামন দ্য গার্থিয়াসল, অ্যাঞ্জেল গোঞ্জালেজ, গারমান ব্লেইবার্গ, জোসে লুই হিদালগো, জোসে হিয়েরো মার্কোস আনা, মারিয়া বেনিতো, আন্তোনিও মাকাদো, ম্যানুয়েল আলতোলাগীর প্রমুখের কবিতায় যুদ্ধ সুরলিয়্যালিজম, রোমান্টিক ও বিপ্লবী চেতনায় সমৃদ্ধ। যুদ্ধের বিচিত্র বিষয় বাংলা কবিতায়ও প্রভাব ফেলেছে গভীর ভাবে। যুদ্ধবিরোধী কাব্যের আসনে, কবিতার ব্যাখ্যা বিষয়ভিত্তিক ভাবে এক। হয়ত উপস্থাপনের কৌশলে ভিন্নতা এসেছে। কবি তাই বলেছেন-

জমির তোর খুব কাছে যেতে চাইছি বিশ্বাস কর
যেখানে তুই সেদিন যেতে চাসনি
সেখানে জোর করেই ওরা তোকে পাঠিয়েছিল

যাবার বেলা হয়নি দেখা
ছিলনা কেউ নিকটে তোর
শুকনো ঠোঁটে একটুখানি জল ঢেলে দেয়
চোখের ধারা মুছিয়ে দিতে মা জননী
তাকেও ওরা যেতে দেয়নি
এমন নিঠুর অসময়ে বড়ই একা কেউ দেখেনি
গুলির ঘাঁয়ে কলজে ছিঁড়ে
রক্তে ভেজা দেহ নিয়েই বিদায় হলি ক্যামন করে
পদ্মা তোকে আপন বুকে ঠাঁই দিয়েই
খুঁজলো তার যে কতশত অতীত জ্বালা

কবির কবিতায় স্বদেশ নিয়ে মনের গভীরে দেখা দেয়া আশঙ্কা আর আকুলতার প্রতিফলন ফুটে উঠলেও যুদ্ধের সর্বগ্রাসী ভয়াবহতা সম্পর্কে সাবধানবাণীও উচ্চারিত হয়েছিল। আর সেখানেই আছে কবিতার মধ্যে দিয়ে কবির ছড়িয়ে দেয়া শান্তি বাণী, যা যুদ্ধের উন্মাদনায় বিভোর জাতিকে বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছিল, কেন যুদ্ধে জয়-পরাজয় আদৌ কোনো নির্ধারক মানদন্ড নয়, যার মধ্যে দিয়ে সাফল্য-ব্যর্থতার ছবি পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠতে পারে। বরং কবির চোখে যুদ্ধের দিক আলোকপাত করে ধ্বংস আর প্রাণহানি এবং বিজয় সব কিছুই তিনি কবিতায় ধারণ করেছেন। কবির স্বাধীনতা চর হাজীগঞ্জ কবিতাটি যুদ্ধের সময়ের বর্ণনা করেছেন অত্যন্ত সাবলিল ভঙ্গিতে। এই জমির কবির // বন্ধু ছিলো। যিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় মারা যায়। কবি তার স্মৃতি চারণ করে এই কবিতাটি লিখেছেন। কবিতাটিতে কবির জন্মস্থান ফরিদপুরের চরহাজীগঞ্জ এবং পদ্মা নদীর বর্ণনা এসেছে। আবার ভিন্ন মাত্রা এনে কবি লিখেছেন-

গাছের পাতার সবুজ খোয়ানো ছবি
ইথিওপিয়া নয়, এই বাংলাদেশে
দেখছি অবশেষে তাই বাংলাদেশে
আবারও হৃদয় খুন দেখতে হবে ?
………………………………
সোনার মানুষ হারাতে দেবোনা আমি
যে করেই হোক বিনাশ ঠেকাতে চাই
………………………………..
যে করেই হোক হৃদয় খুন ঠেকিয়ে আসি
যাও ফিরে যাও খরার মরা বাংলা ছেড়ে। (চমৎকার সাহস-যাও ফিরে যাও)

-এই কবিতায় দেশ প্রেমের পাশাপাশি উঠে এসেছে প্রেমের কথা। দেশ প্রেম এবং মানব প্রেমের এক দ্বি-বিপ্লব প্রেমের প্রকাশ পেয়েছে। চারদিকে সবুজ খোয়ানো বলে কবি অস্থির সময়ের বর্ণনা দিয়েছেন। এখানে ইথিওপিয়ার সাথে বাংলাদেশের তুলনা করে সমাজ, রাষ্ট্রের অবক্ষয়তার চিত্র তুলে ধরেছেন। কবির কবিতায় বহুমাত্রিকতায় ঋদ্ধ। তিনি সংগ্রামকে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য লিখেছেন-

সংগ্রামী বুক আর সেই বুকের সাহস চাই
চাই জীবনের সুখে দুঃখে সামনে চলার গতি
পেছনে আলা জ্বালা পেছনেই পড়ে থাক শুধু
ফেলে আসা দিন মান মনে করে লাভ নেই কোন
……………………………….
সংগ্রামী বুক আর সেই বুকের সাহস চাই
সেদিনের কথা এখন অনেক দূরে আরো দূরে
হারিয়ে যাবার অতীতে ফেরার লোভ পালিয়েছে
তবু রেখে গেছে বারুদের হাসি পরাজিত ঠোঁটে। (চমৎকার সাহস-গোলাপ বাগানে ঝড়)

-যে কোনো মানুষের বুকে সংগ্রাম জেগে ওঠবেই এই কবিতার নির্যাসে। এখানে কবির দূরদর্শিতার এক মূত্যমান চিত্র দেখা যায়। তার কবিতায় সাহস ও চেতনা জাগায়। অন্যদিকে জয়ের সাথে পরাজয়ের বিষয়তো একই সূত্রে গাঁথা সহোদর। তাই সে কথাটিও স্মরণ করে দিয়েছেন। পরাজিত ঠোঁটে বারুদের হাসি। কিন্তু কবি নাছোড় চুইংগাম। হেরে যাবার পাত্র নয় এগিয়ে যাবেন সামনে দিকে। মোটেও কুণ্ঠিত হয়ে পালিয়ে যাবেন না সিরাজদ্দৌলার মত পেছনের দরোজা দিয়ে। তাই কবি বলেছেন-

আব্রাহাম লিংকন
ধরাশায়ী বাংলায়
মাও ফিরে আও
বাণিজ্যিক শোষণ চরমে
আনবিক হুমকি সজোরে
……………………..
মাও ফিরে আও
এই যে রক্তপাত অকারণে
বক ধার্মিক দেয় মাথা চাড়া
মাও ফিরে আও
ধর্মের নামে মিথ্যে কথা বলে
জিকির তোলে গেল ইসলাম
মাও ফিরে আও
ইসলামের চির সত্যবাণী
ধর্মধারণে বাড়াবাড়ি নয়
মাও ফিরে আও। (মাও ফিরে আও)

কবি তার কবিতায় বক ধার্মিক অর্থাৎ ধর্ম ব্যবসায়ীদের উৎপাতের কথা স্মরণ করে দিয়েছেন মানুষকে তার কবিতার ভাষায়। ইসলাম ধর্মকে যারা ব্যবসার পুঁজি করে তাদের থেকে মানুষকে সাবধান করেছেন। মাও সেতুং যিনি চীনের সে অবিসংবাদিত কমিনিজমের নেতা এবং তৎকালীন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আধুনিক গণতন্ত্রের পুরোধা আব্রাহাম লিংকনের কথা স্মরণ করে দিয়েছেন সবাইকে। মাও সেতুং ও আব্রাহাম লিংকনের চেতনার সঠিক বাস্তবায়নের প্রতি ইঙ্গিত দিয়েছেন। সমাজ ও রাষ্ট্রের অবক্ষয় কবির চেতনাকে বিদীর্ণ করেছে যা তিনি কবিতায় বর্ণনা করেছেন। কবিতাতে সরাসরি ম্যাসেজ দিয়েছেন সাধারণ জনতাকে। একজন দায়িত্বশীল বা দায়বদ্ধ কবির যে কাজ সাধারণ মানুষকে সচেতন করা সে কাজ তিনি যথার্থ ভাবে করেছেন বলেই মনে করি। কবির কবিতায় ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস উজ্জ্বল্য কবিতার বর্ণনায় ইতিহাস ঐতিহ্য এবং জাতিসত্তাকে গভীর ভাবে ধারণ করেছেন-

ভাষা আন্দোলনের মিছিল শ্লোগানে
পোস্টার ফেস্টুনে আবজ্র বিপ্লবী দাবী
শ্বাশ্বত সত্য শপথে মানবতার গান
সুরাসুর ভেদী জাগ্রত প্রেম ভালোবাসা
ছড়ায় প্রাণে মা জননীরে আদর মাখা
চিত্তামোদী বিশ্বজয়ী বাংলা ভাষা
দুর্জয় মাটির বুকে পরাজয় চিহ্ণ
আঁকতে পারেনি কোন দুর্বৃত্ত
ঝড় ঝঞ্ঝা সংকট সংগ্রামে
আসে ছুটে একুশ আমাদের কাছে
একাত্তরে এসেছিল যেমন করে
গণজাগরণের সূচনা বিস্তারে
এসেছে একুশের চিরায়ত চিত্তবোধ
ভাষা শহীদের রক্তলাল পথ ধরে
জেগে উঠেছে গণ জাগরণ দিকে চার দিকে
অনিবার্য বিজয় এলো ঐ এলে বলে
শুনছি আওয়াজ জয় বাংলার জয়। (অনিবার্য বিজয় )

-এখানে কবি সেই বায়ান্নের ভাষার জন্য জীবন বাজি রাখা আন্দোলন এবং মাতৃভূমির জন্য সোনার ছেলেদের আত্মত্যাগ বিলীন যেনো হয়ে না যায় এজন্য যত রকম বাধাই আসুক তিনি গণজাগরণকে আহবান জানিয়েছেন চিরন্তণ ভাষায়। আজকে সেই বায়ান্ন এবং একাত্তর যখন বিরোধী হায়ের কবলে পড়ে বার বার তখন কবি আবারো জয় বাংলার ডাক দিয়ে আহবান জানিয়েছেন বিপ্লবীদের।

কবির বিভিন্ন বিষয়ে উল্লেখিত বাণী সমূহ

সাধারণ কথার মধ্যে অসাধারণ বাক্যই বাণী। কবি শেখ সামসুল হক এ বাণী গুলো বিভিন্ন সময়ে তার বিভিন্ন বক্তব্যে বলেছেন। সেখান থেকেই সংগ্রহ করা হয়েছে। তিনি কখনো এ গুলো কোথাও লিখে রাখেননি। বরং কবির সাহিত্য কর্ম নিয়ে কাজ করার অভিপ্রায় থেকেই তার প্রতিটি কথা, গল্পকে ভাল ভাবে শুনা, সেগুলো আয়ত্ব করা এবং বিশ্লেষণ করা হয়েছে ; অনেকটা কবির অজান্তেই। তারই কিছুটা হচ্ছে এ বাণী গুলো। অনেক কথাই তার মুখে বিভিন্ন প্রসঙ্গে শোনা। যা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।

১। পড়া শুনা ছাড়া ভাল লেখা যাবে না। লিখতে হলে পড়তে হবে।
২। লেখায় প্রতিদিনের বিজ্ঞানকে নিয়ে আসুন। তাহলে লেখা ভিন্ন মাত্রা পাবে।
৩। মাধবী আমার একাত্তর বুঝি না কুরুত্রে।
৪। কবিতা হৃদয় উৎসারিত শ্রেষ্ঠ বাণী ধ্বনি।
৫। দৈনন্দিন আবিস্কারকে কবিতায় ধারণ করুন। তাহলে কবিতা অন্যের চেয়ে পৃথক হবে।
৬। কবির স্টকে যখন আর কোনো শব্দ থাকে না তখন কোনো কিছুর ‘মতন’ শব্দ ব্যবহারে উপমা দেন। যেটা কবিতায় নতুনত্বের দাবী করে না।
৭। লেখকের কোন দল নেই।
৮। সাধারণ কথাই কবিতা।
৯। পদক ‘মেধা’ নষ্ট করে।
১০। বড় কবির পাশে ছবি তুললেই বড় কবি হওয়া যায় না।
১১। ‘চেষ্টা করবো’ কথাটি একটা ভাঁওতাবাজি।
১২। কবিতা প্রতিদিন চর্চা করলে এক সময় ভাল কবিতাটি লেখা হয়ে যায়।
১৩। কবিতার ব্যাকরণ জানা আবশ্যক। জেনে নিয়ম ভাঙলে অসুবিধা নেই। কিন্তু না জেনে ছন্দ বিমুখ থাকলে লেখা সময়কে অতিক্রম করতে সক্ষম হয় না।
১৪। ধর্ম হচ্ছে তা; যা মানুষ ধারণ করে।
১৫। একটি ভাল কবিতা এক সময় সর্ব সাধারণের ভাবনা হয়ে ওঠে। -রীনা তালুকদার

কবির কবিতার বৈশিষ্ট্য

১। গীতল ধারায় বিন্যস্ত ভাব প্রধান
২। বিপ্লবের শব্দ মালায় প্রেমের বর্ণনা
৩। তীব্রতর প্রেম তীব্রতর বিপ্লব
৪। কবিতায় গভীর দর্শন বিদ্যমান
৫। অলংকারের যথাযথ ও বিন্যস্ত ব্যবহার
৬। সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট উপমার গভীরতর প্রকাশ ভঙ্গি
৭। কথা মালায় উচ্ছাস ও অনুপ্রেরণা
৮। ছন্দের রিনিঝিনি বেজে ওঠে
৯। নতুন শব্দ সৃষ্টি
১০। কঠিন প্রকরণকে সহজ ও সাবলিল প্রকাশ ভঙ্গি
১১। প্রতিটি লাইন ও পংক্তিতে স্কেলের সঠিক ধাপ
১২। কবিতার ভাষায় কোমল রূপ
১৩। গভীর আলো আঁধারির ঘোর বা আবিষ্টতা জড়িয়ে থাকে
১৪। বক্রোক্তির ভাষায় ভাব প্রকাশ
১৫। সুস্পষ্ট চিত্রকল্প
১৬। তীব্র ভাব রূপকল্প প্রধান।
১৭। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সুর, তাল, লয় বা গতির ধারাবাহিকতা রা করা।
১৮। প্রতিটি বাক্যই পাঠক মনে গেঁথে থাকার মত।
১৯। সহজ কথায় অসাধারণ বাক্য বিন্যাস।
২০। সত্তর দশকে গীতল ধারায় লেখা কবিতার ধারাকে বদলে শূন্য দশকে লেখা কবিতায় বিজ্ঞানের সমন্বয়।

-রীনা তালুকদার

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button