উপ-সম্পাদকীয়

স্যালুট ‘সেই ব্যারিকেডকারীদের’

অনার্স ফাইনাল ইয়ার ভাইভায় আমাকে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিল-আচ্ছা বলেন তো,স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম সশস্ত্র প্রতিবোধ শুরু হয়েছিল কোথা থেকে? এদিক-সেদিক কোন চিন্তা না করেই উত্তরে আমি বলেছিলাম-‘জয়দেবপুর থেকে’। প্রশ্নদাতা একটু হেসে বলে উঠলেন,আপনে গাজীপুরের সন্তান বলেই কি জয়দেবপুর বললেন? আমি বললাম গাজীপুরের সন্তান হয়ে নিজেকে গর্ববোধ করি। কারণ স্বাধীনতা যুদ্ধে যে সাহসী ‘গণ প্রতিরোধ’ প্রয়োজন ছিল,জয়দেবপুরের বীর সন্তানেরাই প্রথম তা দেখিয়েছিলেন। ১৯ মার্চ প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধের এই দিনে আজ যখন লেখতে বসলাম,তখন হঠাতই সেই ভাইভা পরীক্ষার কথা মনে পড়লো। যাক সে কথা, আজ স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধের ৪৭তম বার্ষিকী। ১৯৭১ সালের এই দিনে গাজীপুরে (ততকালিন জয়দেবপুর)দখলদার বর্বর হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে স্বাধীনতাকামী বীর বাঙালিরা জয়দেবপুরের মাটিতেই সূচিত করেছিলেন তাদের প্রতিবাদের যাত্রা। ভাওয়াল রাজবাড়িতে তত্কালীন সেনানিবাসে দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টকে নিরস্ত্র করার উদ্দেশ্যে ব্রিগেড কমান্ডার জাহানজেবের নেতৃত্বে পাঞ্জাব রেজিমেন্টের একদল সৈন্য জয়দেবপুর সেনানিবাসে আগমন করবে এই খবরে জেয়দেবপুরের সর্বস্তরের জনসাধারণ বিক্ষুদ্ধ হয়ে ওঠে। তারা রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড গড়ে তোলতে শুরু করে। ইতিহাস থেকে জানা যায়,গাজীপুরের সাবেক মন্ত্রী ও রাষ্ট্রদূত প্রয়াত শামসুল হক,সাবেক সংসদ সদস্য প্রয়াত হাবিব উল্লাহর,বর্তমান মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক,ততকালিন শ্রমিক নেতা কাজী মোজাম্মেল হোসেন,হাসান উদ্দিন সরকারের নেতৃত্বে সকাল থেকে বিুব্ধ ছাত্র জনতাকে নিয়ে টঙ্গী থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড সৃষ্টি করা হয়। দুপুরের দিকে পাক হানাদার বাহিনী চান্দনা চৌরাস্তায় উপস্থিত লোকজনকে অস্ত্রের মুখে ব্যারিকেড সরাতে বাধ্য করে সেনানিবাসে প্রবেশ করলে বিুব্ধ ছাত্র-জনতা পুনরায় রাস্তায় ব্যারিকেড সৃষ্টি করে। ছাত্র-জনতা জয়দেবপুর রেলওয়ে লেভেল ক্রসিংয়ে মালগাড়ির ওয়াগন ফেলে বন্দুক ও বাঁশের লাঠি নিয়ে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে। সেনানিবাস থেকে ফেরার পথে জয়দেবপুর লেভেল ক্রসিংয়ে পাক হানাদার বাহিনী উপস্থিত হতেই স্থানীয় সাহসী বীরদের বন্দুক গর্জে উঠে। ওই সময় হানাদার বাহিনী পাল্টা গুলিবর্ষণ করলে নিয়ামত আলী,মনু খলিফা শহীদ হন এবং ডা.ইউসুফ আলী সরকার, শাহজাহান, সন্তোষসহ বহু লোক আহত হন। তারপর থেকে সারা দেশে শুরু হয়-‘জয়দেবপুরের পথ ধর,বাংলাদেশ স্বাধীন কর’ স্লোগান। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর এই দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে তত্কালীন ১৬বেঙ্গল রেজিমেন্টের উদ্যোগে ঢাকা-ময়মনসিংহ,ঢাকা-টাঙ্গাইল ও ঢাকা-গাজীপুর সড়কের মিলনস্থল চান্দনা চৌরাস্তায় মুক্তিযোদ্ধার প্রতীক (এক হাতে রাইফেল অপর হাতে গ্রিনেড) মুক্তিযুদ্ধের স্মারক ভাস্কর্য ‘জাগ্রত চৌরঙ্গী’ নির্মাণ করা হয়। জয়দেবপুরের সেই সাহসী গণ প্রতিরোধকারী যাদের জন্য গর্জে উঠেছিলো পুরো জাতি সেসব বীরদের জানাই স্যালুট।

লেখক: রাজীবুল হাসান
সাংবাদিক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button