নওগাঁয় প্রতিবন্ধকাকে হার মানিয়ে পাঁচজন জয়িতার জীবন-সংগ্রামের গল্প
ব্রেলভীর চৌধুরী, নওগাঁ জেলা প্রতিনিধিঃ নওগাঁয় প্রতিবন্ধকতাকে হার মানিয়ে নিজেদের বিজয়ী করেছেন ৫জন নারী। জয়িতা অন্বেষনে বাংলাদেশ শীর্ষক কার্যক্রমের আওতায় ২০১৭ সালে জয়িতা নির্বাচন কমিটির মাধ্যমে নওগাঁ জেলার পত্নীতলা উপজেলায় ৫ ক্যাটাগরীতে ৫ জন জয়িতাকে শ্রেষ্ঠ মনোনীত করা হয়েছে।
মনোনীতরা হলেন, ১. অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী নারী হিসাবে পাটিচরা ইফপির মোবারকপুর গ্রামের সাখোয়াদ হোসেনের স্ত্রী মোছাঃ জান্নাতুন ফেরদাউস, ২. শিক্ষা ও চাকুরী ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী নারী হিসাবে নিরমইল ইফপির ফোকন্দা গ্রামের মৃত আকিমদ্দীনের মেয়ে পরিবানু, ৩. সফল জননী নারী হিসাবে, নজিপুর পৌরসভার হরিরামপুর গ্রামের মৃত জয়নাল আবেদীনের স্ত্রী সামসুন নাহার, ৪. নির্যাতনের বিভিষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যমে জীবন শুরু করা নারী আকবরপুর ইফপির চকমহেশ গ্রামের বাবলুর মেয়ে মাহফুজা খাতুন এবং ৫. সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখা নারী আকবরপুর ইফপির রাউতারা গ্রামের আশরাফুলের স্ত্রী নিলুফা ইয়াসমিন।
১. অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী নারী জান্নাতুন ফেরদৌসঃ ১৯৯৬ সালে সাখাওয়াত হোসেনের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন জান্নাতুন ফেরদাউস। বিবাহিত জীবনে এক ছেলে ও এক মেয়ে। আয় বলতে শুধুই স্বামীর গ্রামের ছোট্ট মুদি দোকান। এমন অবস্থায় কিভাবে সংসারের আয় বাড়ানো যায় সে চেষ্টা করতে থাকেন জান্নাতুন। সে ২০০২ সালে দি হাঙ্গার প্রজেক্ট থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহন করে সেলাই কাজ শুরু করেন। ২০১০ সালে উপজেলা কৃষি অফিস হতে একটি প্রশিক্ষন গ্রহন করেন। আয় হতে জমানো ডিপিএস হতে প্রাথমিকভাবে মাত্র ২৫হাজার টাকা দিয়ে একটি পোল্ট্রি খামার শুরু করেন। বর্তমানে তার খামার হতে কয়েকটি গ্রামের চাহিদা পূরণ হয়। তার খামার থেকে প্রতিমাসে গড়ে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকার মুরগী বিক্রয় হয়। বর্তমানে জান্নাতুন ফেরদাউসকে দেখে এলাকার অনেক নারী সাহস পান এবং কাজ করে বড় হবার স্বপ্ন দেখেন।
২. শিক্ষা ও চাকুরী ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী নারী পরিবানুঃ ফোকন্দা গ্রামের পরিবানু অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি নাম। ২৪ বছর বয়সী পরিবানুর জীবনের চলার পথ খুব সহজ ছিল না। বাবা মৃত, মা অসুস্থ। বিবাহিত জীবনও সুখের ছিল না। তাদের গ্রাম প্রত্যন্ত মফস্বল এলাকায়। যেখানে মেয়েদের শিক্ষা লাভ করা ভাল চোখে দেখা হয় না। পরিবানু এমন অবস্থায় নিজের আগ্রহে বি.এ. পর্যন্ত লেখা পড়া করেন। শিক্ষা লাভ করতে গিয়ে অনেক মন্দ কথা শুনতে হয়েছে, মোকাবিলা করতে হয়েছে প্রতিকূল পারিপার্শ্বিক পরিবেশের। কোন বাধাই পরিবানুকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। বর্তমানে তিনি একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে কর্মরত আছেন। কঠিন প্রতিকূলতা পেরিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। অভাবী পরিবারের শিশুদের শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে তার রয়েছে বিশেষ সহমর্মিতা। পরিবানু এলাকার ছেলে-মেয়েদের কাছে একজন দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী নারী ।
৩. সফল জননী নারী সামসুন নাহারঃ মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেয়া সামসুন নাহার ৫ম শ্রেণীতে লেখা পড়ার সময় বিয়ে হয়। বিয়ের পর ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া চালিয়ে যান। শ্বসুর বাড়ীর চাপে লেখাপড়া আর এগিয়ে নেয়া সম্ভব হয়নি। সংসার জীবনে পাঁচ ছেলে-মেয়ের জননী। ১৯৯৮ সালে স্বামী মারা যায়। তখন বড় মেয়ের বয়স ১৭ বছর একাদশ শ্রেণীর ছাত্রী, বড় ছেলের বয়স ১৫ বছর ৯ম শ্রেণীর ছাত্র, মেজো মেয়ের বয়স ১১ ৬ষ্ট শ্রেণীর ছাত্রী, সেজো ছেলের বয়স ৮ বছর ২য় শ্রেণীর ছাত্র এবং ছোটটি মাত্র ৪ বছরের। পরিবারের আর্থিক সংকট তখন চরমে, মাথার উপর ঋণের বোঝা। বেড়ার বাড়ী ছাড়া সম্বল বলতে কিছুই নাই। নিজের পায়েই দাঁড়াতে হবে এই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন। দিনে অন্যের দোকানে সেলাই মেশিনে দর্জির কাজ, বাড়ীতে গরু-ছাগল পালন, আর বাসাতে ছোট মুদিখানার দোকান, রাতে সেলাই মেশিনের কাজ করে কোন রকমে অতি কষ্টে সন্তান লালন-পালন আর সংসার জীবন চলতে লাগলো। পরে নজিপুর মহিলা কলেজে আয়া পদে চাকুরী পান অনেক চেষ্টায়। বর্তমানে তার ৫ সন্তানের মধ্যে ৪ জনই এম.এ. পাশ ও একজন বি.এ, পাশ। প্রত্যেক সন্তানই সরকারি চাকুরীতে প্রতিষ্ঠিত। এলাকায় সামসুন নাহার একজন সফল জননীর দৃষ্টান্ত।
৪. নির্যাতনের বিভিষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যমে জীবন শুরু করা নারী মাহফুজাঃ চক মহেশ গ্রামের বাবা-মায়ের আদরের ছোট মেয়ে মাহফুজা। মাত্র ১৩ বছর বয়সে নানা-দাদার বয়সী সমাজের এক দুষ্টু লোকের প্রলোভনের ফাঁদে পড়ে মাহফুজা নারী জাতির মুল্যবান সম্পদ হারিয়ে ফেলেন।গর্ভবতী হয় মাহফুজা। পরিনতিতে অকালে কোলে আসে একটি পুত্র সন্তান। কোন কূল পায়না মাহফুজা। এক সময় আত্ম-হত্যার মতো প্রবল ইচ্ছাও চেপে বসেছিল তাঁর মনে। অবশেষে মন শক্ত করে প্রতারকের বিরুদ্ধে মামলা করেন এবং প্রতারককে শাস্তির সন্মুখীন করতে পেরেছেন। বর্তমানে মাহফুজা লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছেন এবং নিজেকে সাবলম্বী করার লক্ষে সেলাই প্রশিক্ষণ গ্রহন করছেন । এলাকায় তিনি একজন প্রতিবাদী নারী হিসেবে সাহসী ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছেন। মাহফুজা আজ সমাজে সকল সীমাবদ্ধতাকে পেছনে নতুন উদ্যমে জীবন শুরু করেছেন।
৫. সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখা নারী নিলুফাঃ পিতা-মাতার ১১জন সন্তানের মধ্যে নিলুফা ইয়াসমিন ৮ম। আর্থিক দৈন্যদশার মাঝেও তাঁর মায়ের প্রেরণায় ও নিজ প্রচেষ্টায় প্রতিকূলতার মাঝে মাধ্যমিক পাশ করেন নিলুফা। বিবাহ পরবর্তী জীবনে নিলুফা প্রথমে ব্র্যাক প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠা হলে তিনি সেখানে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। এরপর পত্নীতলা উপজেলার বিজ এর আওতায় পুষ্টি কার্যক্রম শুরু হলে মাঠকর্মী হিসেবে আকবরপুর ইউনিয়নে কার্যক্রম শুরু করেন। ইতিমধ্যে সামাজিক সমস্যা সমাধানে মানুষকে সহায়তার মধ্য দিয়ে এলাকায় গুরুত্বপূর্ণ মানুষ হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। এছাড়াও বসতবাড়িতে সবজি চাষ, কম্পোষ্ট তৈরী, জৈব সার প্রস্তুত, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সহায়তাসহ বিভিন্ন কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়েন নিলুফা ইয়াসমিন।
২০১৬ সালে ইউপি নির্বাচনে এলাকার মানুষজন সংরক্ষিত নারী সদস্য হিসেবে নিলুফাকে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন। সামাজিক সমস্যা সমাধানের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এলাকার নারীদের সংগঠিত করে অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছেন নিলুফা ইয়াসমিন। প্রায় ১২বছর যাবৎ প্রতিবন্ধী জনগোষ্টিকে সমাজের মূলধারায় প্রবেশের লক্ষে এডভোকেসিমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছেন। নারী ও শিশু নির্যাতন বন্ধ এবং নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় আপোসহীন নেত্রী হিসেবে তিনি এলাকায় সুপরিচিত। আকবরপুর ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডকে শতভাগ স্যানিটেশন অর্জন করতে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। এলাকার সকল শিশুর বিদ্যালয়ে ভর্তি নিশ্চিতকরণ, গর্ভবতী ও প্রসূতি মায়ের পরিচর্যা করা ও বিচার শালিসে নারীদের মতামতের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করা, গ্রামের পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখতে জন সচেনতামূলক কাজ করে চলেছেন নিলুফা ইয়াসমিন। তিনি প্রায় ২০ বছর ধরে কাজ করে চলেছেন। শুধু নিজের এলাকা নয়, ইউনিয়নের প্রায় ৩০টি গ্রামে সংগঠন গড়ে তোলার মাধ্যমে টেকসই বাংলাদেশ বির্নিমানে অগ্রণী ভূমিকা রাখছেন নিলুফা ইয়াসমিন।
উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা মাহমুদা সুলতানা জানান, সমাজের নানা প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে এগিয়ে চলেছে উপজেলার শ্রেষ্ঠ এই পাঁচ জন জয়িতা। তাদের সংগ্রাম অন্যান্য নারীদের জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে এবং সামনে পথ চলার প্রেরনা যোগাবে।