পাঠক কলামপাঠক কলামমতামত

আনিসুজ্জামান স্যারকে শ্রদ্ধায় স্মরণ

মাহদী হাসান খান:-

“বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি।
দেশে দেশে কত-না নগর রাজধানী—
মানুষের কত কীর্তি, কত নদী গিরি সিন্ধু মরু,
কত-না অজানা জীব, কত-না অপরিচিত তরু
রয়ে গেল অগোচরে। বিশাল বিশ্বের আয়োজন;
মন মোর জুড়ে থাকে অতি ক্ষুদ্র তারি এক কোণ।
সেই ক্ষোভে পড়ি গ্রন্থ ভ্রমণবৃত্তান্ত আছে যাহে
অক্ষয় উৎসাহে—
যেথা পাই চিত্রময়ী বর্ণনার বাণী
কুড়াইয়া আনি।”

– (ঐকতান,জন্মদিনে :রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

” বাংলা ও ইংরাজী পাঠের মধ্যে বিরোধের ক্ষেত্রে বাংলা পাঠ প্রাধান্য পাইবে ”
-(অনুচ্ছেদ ১৫৩ (৩) : গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান)

আবু তৈয়ব মহম্মদ আনিসুজ্জামান ( ১৯৩৭ -২০২০) যিনি mononymously আনিসুজ্জামান হিসেবে পরিচিত ছিলেন। এই একাংশিক নামের সাথে আমার পরিচয় সম্ভবত ১৯৯৮ সনে। প্রথম আলো পত্রিকা প্রকাশের পরপর ধারাবাহিকভাবে প্রতি শুক্রবার ছাপা হচ্ছিল আনিসুজ্জামান স্যারের
আত্মজৈবনিক রচনা – “বিপুলা পৃথিবী ” সেটি পড়তাম, সে বয়সে তাঁর কর্মময় জীবনের বহুমাত্রিকতা আমাকে বিস্মিত করতো।

২০০৫ সনের মে মাসের মাঝামাঝি এক দিনে ঢাকা বিশ্বনিদ্যালয় আইন বিভাগে গিয়ে ভর্তি হয়েছিলাম। ক্যাম্পাসে আনিস স্যারকে দেখতাম, সভা সেমিনার অনুষ্ঠানাদিতে আলোচনা শুনতাম।আইনের ছাত্র ও বাংলা লেখালেখির প্রতি অনুরাগের ফলেই বাংলাদেশের সংবিধানের বাংলা ভাষ্যের প্রণেতার প্রতি একটা অনন্য সমিহের বোধ ছিল সবসময়। ২০১২ সনের ফেব্রুয়ারিতে কলকাতায় একুশে ফেব্রুয়ারির এক টিভি অনুষ্ঠানে আলোচনা ও আবৃত্তি করার আমন্ত্রণে গিয়েছিলাম। রবীন্দ্রভারতীর সাবেক উপাচার্য ও পরবর্তিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রবীন্দ্র চেয়ার অধ্যাপক করুনাসিন্ধু সেদিন কলকাতায় বাংলাদেশের উপ হাইকমিশন আয়োজিত অনুষ্ঠানে ছিলেন, রাজনীতিক বিমান বসু, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এ এইচ এম মোস্তাফিজুর রহমান স্যার ছিলেন সে অনুষ্ঠানে। টক শো তে একজন ভারতীয় বাঙালি মহিলা কবি বাংলা প্রশ্নে দুই বাংলার মানুষের অনুভুতির কথা বলছিলেন। বলছিলেন বাংলাদেশের জাতীয় যাদুঘরে গিয়ে বাংলায় লেখা পৃথিবীর একমাত্র রাষ্ট্রের সংবিধানের কপিটি দেখে তার আপ্লুত হওয়ার কথা। মনে আছে সেখানেও আনিস স্যারের প্রসঙ্গ এসেছিল অন এয়ারের বাইরেও কিছুক্ষন চা খেতে খেতে। বিষয়টি সেদিন থেকে আমার মাথায় অন্যভাবে গেঁথে গেল ” বাংলা ভাষায় বিশ্বের একমাত্র সংবিধান “।

 

আনিসুজ্জামান এভাবে একজন বাঙালি, একজন নাগরিক ও একজন আইন ছাত্রের কাছে প্রাসঙ্গিক। উপরন্তু তার আরেক অবদান ‘আইন শব্দকোষ’ প্রণয়ন।

গতকাল তার মৃত্যুর পর সিনিয়র জুনিয়র বন্ধু বান্ধবদের দেয়াল থেকে কিছু ছবি পেলাম।
বহু স্মৃতি মনে পড়ে গেল, ২০১০ সনে বঙ্গবন্ধু হল ডিবেটিং ক্লাবের যুগপূর্তির উৎসবে আমাদের এক অনুষ্ঠানে প্রধান বক্তা হিসেবে এসেছিলেন স্যার।
সে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত ভিসি হারুন স্যার, বিশেষ অতিথি ছিলেন কবি Baitullah Quaderee স্যার।
ছবি দেখে মনে পড়ছে মাহবুবা নাসরিন ম্যাডাম,শাকের সবুর স্যারও ছিলেন সে অনুষ্ঠানে।যুগপূর্তির সে অনুষ্ঠানে সাবেক ও বর্তমানদের মধ্যে স্মৃতিচারনের পর্বই ছিল বড়। মাহবুবা ম্যাডাম আমাদের হলের হাউজ টিউটর্স কোয়ার্টারে তার বিবাহিত জীবনের প্রথম দিনগুলোর স্মৃতিচারন করেছিলেন। আনিস স্যার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময় ও পরবর্তিতে বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্বের জায়গায় এর ভূমিকা সম্পর্কে বলেছিলেন।

আজ বন্ধুদের মারফত এটা একটা অসামান্য স্মৃতি হয়ে ফিরে এলো, প্রবাদপ্রতিম এ বুদ্ধিজীবির উপস্থিতিতে সে অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেছিলাম আমি।

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবন যেসব কারনে অনন্য ছিল, তার একটা স্রেফ এমন যে – আমরা আনিস স্যারদের মাপের শিক্ষকদের ক্যাম্পাসে হাঁটতে চলতে দেখতাম।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button