বিচিত্র দুনিয়া

চোখ নয়, প্রজাপতির শরীরজুড়ে কান

ভালুকা নিউজ ডট কম ডেস্ক : শত্রু প্রতিরোধে বা চোখ ফাঁকি দিতে মানুষের রয়েছে নানা কৌশল আর প্রযুক্তি। এসব প্রযুক্তি ব্যবহার করে একদিকে যেমন মানুষ তার শত্রুর উপস্থিতি টের পায়, তেমনি বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে হটিয়ে দেয় শত্রুকে। বিমান শনাক্তকারী রাডারের কথাই ধরা যাক: শত্রুপক্ষের বিমান নিজের আকাশসীমায় প্রবেশের সাথে সাথেই তা শনাক্ত করতে পারে।

তবে শত্রুকে শনাক্ত করার এই প্রযুক্তিটি শুধু মানুষই ব্যবহার করে না। ব্যবহার করে প্রজাপতিরাও। তাদের পদ্ধতিটা অবশ্য একটু ‍ভিন্ন। বলা যায়, ‘প্রাকৃতিক প্রযুক্তি’। ‘ইস্টার্ন ফোবি’ নামের পতঙ্গ ভক্ষণকারী পাখিগুলোর কাছে খুবই সুস্বাদু খাবার হচ্ছে প্রজাপতিসহ বিভিন্ন ধরনের পতঙ্গ। আর এ ধরনের শিকারীদের মোকাবেলায় ওই ‘প্রাকৃতিক প্রযুক্তি’ ব্যবহার করে প্রজাপতি।

বিষয়টি নিয়ে তিন দশক ধরে গবেষণা করছেন কানাডার কার্লটন বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক জেন ইয়াক। নিজের বাসা থেকে প্রায় ১০ মিটার দূরে একটি গাছের সাথে সুতা দিয়ে একটি প্রজাপতিকে বেঁধে রাখেন তিনি। সুতাটি তিনি বেঁধেছিলেন প্রজাপতিটির ঠিক পেটের সাথে এবং এটিকে এমনভাবে রেখেছিলেন যেন যেকোনো প্রজাপতি ভক্ষণকারী পাখি সেটিকে সহজেই দেখতে পায়।

খুব শিগগিরই একটি ইস্টার্ন ফোবি প্রজাপতিটিকে ছোঁ মেরে নিয়ে যায়। এদিকে পাখিটির আক্রমণের শব্দ রেকর্ড করার জন্য আগে থেকেই একটি গোপন মাইক্রোফোন পাশে স্থাপন করে রেখেছিলেন ইয়াক। যাতে পরে ওই শব্দটিকে ব্যবহার করে তিনি বুঝতে পারেন, কীট-পতঙ্গরা তাদের সম্ভাব্য আক্রমণকারীদের আগেই শনাক্ত করতে পারে কি না। প্রজাপতিটির ওপর হানা দেয়ার সাথে সাথে মাইক্রোফোনে রেকর্ড হয়ে যায় পাখিটির আক্রমণের শব্দ।

ইয়াক জানান, প্রজাপতির মতো পতঙ্গগুলো বাতাসে শব্দের তরঙ্গদৈর্ঘ্য শনাক্ত করতে পারে। বিষয়টি এতোদিন পর্যন্ত আমাদের অজানা ছিল। এটি হলো প্রজাপতিদের একটি গোপন সংবেদনশীল জগৎ। তবে এখন ধীরে ধীরে আমরা বিষয়টি বুঝতে শুরু করেছি। মানুষ এবং পতঙ্গদের কান প্রায় একইভাবে শব্দ শুনতে পায়। শব্দ তরঙ্গের ভেতর দিয়ে বাতাসের মাধ্যমে প্রবাহিত হয়। এটি প্রথমে আমাদের কানের ঝিল্লি বা পর্দায় আঘাত করে। এতে কানের ঝিল্লিতে কম্পনের সৃষ্টি হয়। ব্যাপারটিকে বলা যেতে পারে, ঢাকের ওপরে কাঠি দিয়ে আঘাত করার মতো।

মানুষের ক্ষেত্রে এই কম্পন কানের ভেতরে ককলিয়াতে (অন্তঃকর্ণ) পৌঁছে যায়। আর পতঙ্গের ক্ষেত্রে তাদের দেহের একটি বিশেষ জায়গায় পৌঁছে যায়, যাকে বলা হয়, পতঙ্গের ‘করডন্টাল’ অঙ্গ। এই কম্পনের ফলাফল উভয়ের ক্ষেত্রে একই রকম হয়। শব্দটিকে গ্রহণের জন্য শ্রবণেন্দ্রীয় মস্তিষ্কে একটি বৈদ্যুতিক সংকেত পাঠায়।

গত তিন দশক ধরে শুঁয়োপোকা, গোবরেপোকা এবং প্রজাপতিসহ বিভিন্ন ধরনের পতঙ্গের শ্রবণসীমা নিয়ে গবেষণা করছেন ইয়াক। তিনি জানান, প্রজাপতির সারা দেহেই শ্রবণেন্দ্রীয় আছে। তাদের বুকে, পেটে, পায়ে, মুখে এমনকি তাদের পাখায়ও। প্রত্যেক প্রজাতির প্রাণিরই আলাদা আকার ও পুরুত্বের কম্পনশীল ঝিল্লি থাকে। এতে বোঝা যায়, বিভিন্ন ফ্রিকোয়েন্সিতে আসা শব্দের ক্ষেত্রে ঝিল্লিগুলো বিভিন্নভাবে অনুরণিত হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আমাদের মধ্যকর্ণের ঝিল্লিগুলো মাত্র ২০ থেকে ২০ হাজার হার্জের ফ্রিকোয়েন্সিতে কম্পন সৃষ্টি করতে পারে।

এর থেকে কমবেশি হলে আপনার ঝিল্লিগুলো কম্পিত হবে না। আর আপনিও কোনো শব্দ শুনতে পাবেন না। অর্থাৎ শব্দ শোনার জন্য আমরা পুরোপুরিই মধ্যকর্ণের ঝিল্লিগুলোর ওপর নির্ভরশীল। তার মানে আমরা এখন যে শব্দগুলো শুনতে পাচ্ছি না তার কারণ আমাদের কান নির্দিষ্ট ফ্রিকোয়েন্সির বাইরের তরঙ্গদৈর্ঘ্য ধারণ করতে পারছে না।

ইয়াক বলেন, ‘আমি সব সময়ই পতঙ্গের শোনার বিষয়টির প্রতি আগ্রহী এবং বুঝতে চেষ্টা করি, কোন শব্দ থেকে তারা আসলে কী বুঝতে পারে। আমি শুধু তাদের শব্দ শোনার বিষয়টিই জানতে চাই না, এর পেছনের কারণটাও জানতে চাই।’ তিনি জানান, বাদুরের উচ্চ ফ্রিকোয়েন্সির শব্দগুলোও (শ্রবণোত্তর) পতঙ্গরা শুনতে পায়। যেহেতু প্রজাপতি ছাড়া অন্য পতঙ্গগুলো নিশাচর এবং এ কারণে বাদুর তাদের খায়। তাই বাদুরের শব্দ শুনতে পাওয়াটাও তাদের জন্য খুব দরকার।

পতঙ্গের এ ক্ষমতাটি পরীক্ষা করার জন্য কুকুর প্রশিক্ষণের কাজে ব্যবহৃত একটি যন্ত্র ব্যবহার করেছেন ইয়াক। ওই যন্ত্রটি থেকে উচ্চস্বর এবং উচ্চ ফ্রিকোয়েন্সির শব্দ নির্গত হয়, যা কুকুর এবং পতঙ্গ- উভয় শ্রেণিই শুনতে পায়। ইয়াক জানান, পতঙ্গেরা সাধারণত সোজা পথে চলতে পছন্দ করে। তবে যখন তারা ভয় পাওয়ার মতো কোনো শব্দ শুনতে পায় তখন তারা ডানে বামে, উপরে নিচে আঁকাবাঁকাভাবে চলতে থাকে। এভাবে চলার কারণ যাতে তারা শিকারিদের প্রতারিত করতে পারে। এটাকে শিকারিদের সাথে এক ধরনের ‘মস্করা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন ইয়াক।

তবে পতঙ্গের মধ্যে প্রজাপতিরা সব সময়ই একটু আঁকাবাঁকাভাবে চলতে পছন্দ করে। এতে তারা সহজেই শিকারি পাখিদের আয়ত্তের বাইরে থাকতে পারে। তার মানে ওড়ার সময় সর্বদাই প্রতিরক্ষামূলক অবস্থায় থাকে প্রজাপতি। সারা দেহে বিদ্যমান নিজেদের শ্রবণেন্দ্রীয় ব্যবহার করে সব সময়ই শত্রুর অবস্থান শনাক্ত করার চেষ্টা করে প্রজাপতি। প্রজপতির ক্ষেত্রে পাখির ডানার রেকর্ড করা শব্দ ব্যবহার করে পরীক্ষাটি করেছেন ইয়াক।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button