শিরোনামহীন

বৈশাখ:বাঙালীর সার্বজনীন উৎসব। সফিউল্লাহ আনসারী

 

 “মুছে যাক গ্লানি ঘুছে যাক জরা অগ্নি স্নানে সূচী হোক ধরা। রসের আবেশ রাশি শুষ্ক করে দাও আসি আনো আনো আনো তব প্রলয়ের শাঁখ মায়ার কুজ্ঝটিজাল যাক দূরে যাক। এসো হে বৈশাখ এসো এসো” এসো হে বৈশাখ….. কবি গুরুর অসাধারণ রচনা,যা না হলে হয়তো বৈশাখ পালনে অপুর্ণতা থেকে যেতো।বাংলা এবং বাঙালীর ঐতিহ্যের প্রতীক পয়লা বৈশাখ।আর বৈশাখের ছন্দ-উচ্ছাস এসো হে বৈশাখ’গানটি।বৈশাখ মানেই বাঙালীর সার্বজনীন উৎসব।বাঙালীর চিরায়ত সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ মানেই পহেলা বৈশাখ।বৈশাখকে ঘিরে বাঙালীর চেতনা জুড়ে রয়েছে অন্যরকম আবেগ,উৎসাহ ও দেশীয় সংস্কৃতিকে ধারন করার আবেগ-অনুভূতি।বৈশাখ মানেই উচ্ছাস,উত্তাপ,উল্লাস আর উৎসবের আমেজ।চারদিকে সাজ সাজ রব দেশের সকল প্রান্তকেই আলোড়িত করে।মানুষের বিশ্বাস বৈশাখের আগমন ঘটে সূচী-শুভ্র-নির্মল-পবিত্রতায়। প্রতি বছর ১৪ এপ্রিল বাংলা নববর্ষ বা ১ লা বৈশাখ পালন করা হয়।পহেলা বৈশাখকে ঘিরে শহর,গ্রাম-গঞ্জে নানা উৎসব-পার্বণের আয়োজনে থাকে মুখরিত।বৈশাখের এ সার্বজনিন উৎসব দেশের প্রতিটা মানুষকে নানাভাবে ঐতিহ্যের ভাবনায় সমৃদ্ধ করে।সারাদেশে বৈশাখী মেলায় বাংলার সংস্কৃতি প্রসারিত ও লোকশিল্প তার আপন ঐতিহ্যকে ছড়িয়ে দেয় স্ব-মহিমায়।বাঙালী রমনীদের নানা রঙের শাড়ীতে সাঁজ ও ছেলে-বুড়োদের পোষাকে থাকে বৈশাখের আকিঁবুকি।বিভিন্ন পোষাক প্রস্তুতকারী নামি-দামি ব্র্যান্ড বৈশাখে রঙ-বেরঙের শাড়ী,টি শার্ট,ফতোয়াসহা নানা ধরনের কাপড় তৈরী করে বাজারজাত করে থাকেন।বৈশাখে শুধু আনুষ্ঠানিকতায় নয় এখন ব্যবসাতেও আনে সমৃদ্ধি।ঢোলের শব্দে নৃ্ত্যরা যেনো নিজেই নাচের তালে থাকে ‍মুখর।চোখ জুড়ানো রং-বেরঙের হাঁড়ি-পাতিল খেলনা আর হরেক স্বাদের মিষ্টান্নের পসরায় সাজে মেলা-প্রাঙ্গণ।দেশের শহর-নগর-বন্দরে আয়োজন থাকে ইলিশ মাছ দিয়ে পান্তা ভাতের।বৈশাখী মেলার প্রাঞ্জলতা মানুষের হৃদয়কে পরিপূর্ণ করে,করে আনন্দিত। এ সব মেলাতে বসে কুটির শিল্প সামগ্রীর  বাহারি দোকানের বিক্রয় ও প্রদর্শনী,থাকে নানা রকম পিঠাপুলির আয়োজনও।নৌকাবাইচ, লাঠি খেলা ওকুস্তি,কাছিটান,হাডুডু,ফুটবল,ঘোড়াদৌড়সহ নানা ধরনের খেলাধুলারও আয়োজন করা হয়ে থাকে বৈশাখকে উপলক্ষ করে।ঢাকা শহরে বৈশাখের প্রথমদিনে মঙ্গল শোভাযাত্রা বর্তমানে পহেলা বৈশাখ উদযাপনের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ,সাংস্কৃতির ঐতিহ্য হিসেবে উদযাপিত হচ্ছে।রমনার বটমূলে অসাম্প্রদায়ীক আনুষ্ঠানিকতা বৈশাখ যাপনের গুরুত্বকে অর্থবহ করেছে।অশুভ শক্তির বিনাশ,শুভ শক্তির উদয়ে এই মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজনে নানা পেশা-শ্রেণীর মানুষ অংশ নিয়ে থাকে।অসাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে ধারন করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ঋদ্ধ এই শোভাযাত্রায় শুদ্ধতা চর্চাকে উৎসাহীত করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার ছাত্র-শিক্ষকদের উদ্যোগে ১৯৮৯ সালে শুরু হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। বিশাল আয়োজনের এ মঙ্গল শোভাযাত্রায় হাতি, বাঘ,ঘোড়া,পাপেট,ময়ূর,লক্ষ্মীপেঁচা,কুমিরসহ নানা ধরনের মুখোশ শোভা পায়।এসবের মধ্য দিয়ে হাজার বছরের বাঙালীর চলমান রাজনীতি থেকে শুরু করে নানা রকম সঙ্গতি-অসঙ্গতি ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ,সামাজিক,অর্থনৈতিক বাস্তবতা রুপকের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়।শিল্পি,কবি-সাহিত্যিকদের স্বপ্রতীভ পদচারনায় এদিনটি থাকে উৎসবমুখর।বৈশাখের আগমনে প্রাণের জোয়ার জাগে বাঙালীর জীবনে-জীবনে।ধর্ম-বর্ণ,জাতী নির্বিশেষে পহেলা বৈশাখ বাঙালীর মন-মননে অন্যরকম আনন্দ উৎসবে থাকে উদ্বেলিত।মুসলমান সমাজে বৈশাখ বরণে তেমন নিয়ম-কানুন না থাকলেও হিন্দু ও অন্যান্য ধর্মালম্বিদের রয়েছে আলাদা স্বাতন্ত্র ও রেওয়াজ।তবে পয়লা বৈশাখের এ সময়ে ভেদাভেদহীন অংশগ্রহনে বৈশাখী উৎসব বাংলাদেশের প্রতিটা ঘরে অন্যরকম আনন্দে পালিত হয়।মেলাতে বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে রাখা হয় নাগরদোলা, পুতুলনাচ ও সার্কাসসহ মেলার ক্লান্তি দূর করতে যোগ হয় কীর্তন গান।পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসীদের মধ্যেও নানা আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পহেলা বৈশাখ উদযাপন করা হয়ে থাকে।বর্ষবরণে চাকমারা ও মারমারাও উৎসব পালন করে। পালন করে বৈশাখী উৎসব।বৈশাখী পূর্ণিমা উদযাপনও নৃ-গোষ্ঠীর ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের মতোই গুরুত্ব পায় ।বাংলাদেশে আদিবাসী সমাজ ঐতিহ্যবাহী পিঠা দিয়ে অতিথি আপ্যায়ন,খেলাধুলার আয়োজন,বৌদ্ধ মন্দিরে বুদ্ধ প্রণাম, ধর্ম উপদেশ প্রার্থনাসহ নানা ধরনের কর্মযজ্ঞে ব্যাস্ত সময় পার করে এই বৈশাখে।কোঁচ,সাঁওতাল,ওরাও,গারো,ম্রো,মোরাং,মান্দাই,হাজংসহ আদিবাসীরা তাদের নিজ নিজ সংস্কৃতি অনুযায়ী বৈশাখ উদযাপন করে থাকে অনেকটা ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের মধ্যদিয়ে।বাংলা নবর্বষ আসে ১২টি মাসের তেরো পার্বন নিয়ে। এই ১২ মাস নিয়েও রয়েছে নামকরনের ঐতিহ্যগাথা কথকথা।প্রচলিত আছে,এই মাসগুলোর নাম সৌরজগতের মন্ডলীর নামানুসারে হয়েছে-যেমনঃ১. বৈশাখ মাস এসেছে বিশাখা থেকে,২. জৈষ্ঠ্য এসেছে জাইষ্ঠ্যা থেকে,৩. আষাঢ় এসেছে ষাঢ় থেকে,৪. শ্রাবণ এসেছে শ্রাবণী থেকে,৫. ভাদ্র এসেছে ভাদ্রপদা থেকে,৬. আশ্বিন এসেছে আশআনি থেকে,৭. কার্তিক এসেছে কার্তিকা থেকে,৮. অগ্রহায়ণ এসেছে আগ্রাইহন থেকে,৯. পৌষ এসেছে পৌষিয়া থেকে,১০. মাঘ এসেছে মাঘা থেকে,১১. ফাল্গুন এসেছে ফাল্গুনি থেকে ও ১২. চৈত্র এসেছে চিত্রা থেকে।(মাসের নামের বিষয়টি সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য নয়)।বছরের পয়লা মাস বৈশাখকে ঘিরে যতোটা উত্তাপ অন্য মাসগুলোতে তেমনটা না হলেও ষড়ঋতুর বৈচিত্রে ভরপুর বাংলায় বারোটি মাসে উৎসবের কমতি থাকেনা কোন। বৈশাখ আসে নতুনের উল্লাসে,পুরাতনকে বিদায় করে বাংলা এবং বাঙালীর জীবন ও সময়কে রঙিন-মঙ্গলময় করে দিতে।যতো পাপ-তাপ-গ্লানি মুছে দিয়ে বৈশাখ হয়ে উঠে বাঙালী সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ।আর এই বৈশাখ উদযাপন দেশ বিদেশে আমাদের নিজস্ব ঐতিহ্যকেও প্রকাশ করে আনন্দ উদ্দীপনায়।বাঙালী সারাবছরের জীর্নতা শেষে নতুন দিনের প্রত্যাশায় বরণ করে নেয় বছরের প্রথম দিন,পয়লা বৈশাখ,নববর্ষকে।পহেলা বৈশাখ বাঙালীর প্রেরণা-এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়কে শানিত করে,করে উজ্জীবিত বছর জুড়েই।শত ব্যাস্ততায়ও, মহাকালের চিরায়ত নিয়মে বৈশাখ বরণে,নববর্ষের উদ্দীপনায় মেতে উঠে বাংলার সকল শ্রেণী-পেশার মানুষ।বৈশাখ যে বাঙালীর সার্বজনিন উৎসব তার প্রমাণ এই পয়লা বৈশাখ এবং বৈশাখ বরণের আনুষ্ঠানিকতা।অবিরাম শুভ কামনায় বাংলা নববর্ষ-১৪২৩ বঙ্গাব্দে সবাইকে জানাই শুভ নববর্ষ।শুভ হোক প্রতিটা ভোর,প্রতিটা প্রহর,প্রতিটা ক্ষণ,এই আন্তরিক শুভ কামনা আজ এই শুভ ক্ষণে।

 

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button