অপরাধ অনুসন্ধান

নাসিরনগরে হামলা : আ’লীগের বহিষ্কৃতরা আলোচনায়!

ভালুকা নিউজ ডট কম; বিশেষ প্রতিবেদক: ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে ৫ দিনের ব্যবধানে দুই দফা হিন্দুদের বাড়িঘর ও মন্দিরে হামলার বিষয়টি এখন রাজনৈতিক বিতর্কে পরিণত হয়েছে। শনিবার এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির শীর্ষ নেতারা পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দিয়েছেন। আর এর সূত্র ছিল স্থানীয় ৩ আওয়ামী লীগ নেতাকে বহিষ্কার। এদিকে জেলা আওয়ামী লীগের নেতারাও বলছেন, ওই ৩ নেতা আসলে ঘটনায় অংশ নিয়েছিলেন নাকি হামলাকারীদের নিবৃত্ত করতে গিয়েছিলেন তা নিয়ে এখনো দলীয় তদন্ত চলছে।

নাসিরনগরের ঘটনার পরপরই কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ঘটনা খতিয়ে দেখতে প্রতিনিধি পাঠানো হয়। এরপর শুক্রবার আওয়ামী লীগের নাসিরনগর উপজেলার সহ-সম্পাদক আবুল হাসেম, হরিপুর ইউনিয়নের সভাপতি ফারুক মিয়া ও চাপরতলা ইউনিয়নের সভাপতি সুরুজ আলীকে দল থেকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়।

এরপর শনিবার দুপুরে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান হাফিজউদ্দীন আহমেদ এক আলোচনায় বলেন, বহিষ্কারের মাধ্যমেই ঘটনায় আওয়ামী লীগের সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া গেছে। তবে এর প্রতিক্রিয়ায় বিকেলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ দলের পক্ষে এক সংবাদ সম্মেলন ডাকেন। তিনি জানান, ঘটনায় সম্পৃক্ততা নয়, বরং দায়িত্বে অবহেলার কারণে দলের ৩ নেতাকে বহিষ্কার করা হয়েছে।

বহিষ্কার নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্কের মধ্যেই শনিবার রাতে ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আল মামুন সরকার পরিবর্তন ডটকমকে ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, এ ৩ নেতা হামলাকারীদের নিবৃত্ত করতেও অংশ নিতে পারেন।

মামুন সরকার পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, ভিডিও ফুটেজে আমরা তাদের ঘটনাস্থলে (হামলার পূর্বের সমাবেশে) দেখতে পেয়েছি। সেজন্যই তাদের সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। কিন্তু তারা উপস্থিত হয়ে হামলায় অংশগ্রহণ করেছিলেন নাকি হামলাকারীদের নিবৃত্ত করতে সেখানে গিয়েছিলেন- সেটা এখন তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।

ইতোমধ্যেই জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি হেলাল উদ্দীনকে আহ্বায়ক করে ৫ সদস্যের একটি অভ্যন্তরীণ তদন্ত কমিটি গঠন করেছে জেলা আওয়ামী লীগ। তবে ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে এ তদন্ত কতটুকু নিরপেক্ষ হবে তা নিয়ে খোদ স্থানীয় আওয়ামী লীগেই গুঞ্জন রয়েছে।

গত মার্চের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের মনোনয়ন নিয়ে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি র আ ম ওবায়দুল মোক্তাদির চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক আল মামুন সরকারের সঙ্গে মৎস্য ও প্রাণীসম্পদমন্ত্রী এবং নাসিরনগরের এমপি ছায়েদুল হকের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে চলে আসে। ওইসময় হরিপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ফারুক মিয়াকে মন্ত্রী নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন দিলেও জেলা আওয়ামী লীগের নেতারা ফারুকের বাবা রাজাকার ছিলেন বলে এর বিরোধীতা করে মনোনয়ন বাতিল করেন। পরে জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টার পদ থেকেও মন্ত্রীকে অব্যাহতি দেয় জেলা আওয়ামী লীগ।

আর নাসিরনগরের ঘটনায় ফারুক মিয়াসহ অভিযুক্ত ৩ জনই মন্ত্রীর সমর্থক বলে পরিচিত, দলের যে অংশটি জেলা আওয়ামী লীগে এখন অনেকটাই কোণঠাসা।

তবে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আল মামুন সরকার মন্ত্রীর পক্ষেই কথা বললেন। হিন্দু সম্প্রদায়কে মন্ত্রীর ‘কটাক্ষ করে বক্তব্য প্রদানের’ অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, তিনি হয়তো বলেছেন যে, সাংবাদিকরা বিষয়টি নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করছে। তবে এটি সরকার বা দলের বক্তব্য না। তিনি এলাকায় এসে তার লোকজনের কাছ থেকে যা জেনেছেন তার পরিপ্রেক্ষিতেই হয়তো তাৎক্ষণিক বক্তব্য দিয়েছেন।

তিনি বলেন, একজন প্রবীণ ব্যক্তি হিসেবে তিনি এ ধরনের কথা বলতে পারেন না বলেই আমি বিশ্বাস করি। তবে বাস্তবতা কি তা আমি জানি না।

এদিকে শনিবার বিকেলে দলের সংবাদ সম্মেলনে মাহবুব-উল আলম হানিফও একই সুরে বলেছেন যে, মন্ত্রী এ্রলাকার ছয়বারের নির্বাচিত এমপি। এ ধরনের অযৌক্তিক ও অগ্রহণযোগ্য বক্তব্য তিনি করেছেন এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। এর প্রমাণ দিতে পারলে তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

তবে এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী অ্যাডভোকেট ছায়েদুল হকের মুঠোফোন নাম্বারটি বন্ধ পাওয়া গেছে। তার ব্যক্তিগত সহকারী মিজানুর রহমানকে একাধিকবার ফোন দেওয়া হলেও তিনি ধরেননি।

এছাড়া জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি র আ ম ওবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী, সহ-সভাপতি ও সাবেক এমপি মোহাম্মদ শাহ আলমকে ফোন দেওয়া হলেও ব্যস্ততা দেখিয়ে তারা কথা বলতে চাননি।

এদিকে সম্পৃক্তদের কঠোর শাস্তি প্রদান করতে নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া উচিত বলে মনে করেন জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা ও এমপি ক্যাপ্টেন (অব) এ বি তাজুল ইসলাম। সাবেক এ প্রতিমন্ত্রী বলেন, এ ঘটনায় তদন্ত হচ্ছে, তাই কোনো কথা বললে তা প্রভাবিত হতে পারে। তবে যা হয়েছে তা খুবই অন্যায় কাজ। এটি দেশের কৃষ্টি, সভ্যতার সাথে খাপ খায় না। তদন্ত করে অপরাধীদের বের করে প্রচণ্ড রকমভাবে শাস্তি দিতে হবে, যাতে করে ভবিষ্যতে কেউ এ ধরনের কাজের পুনরাবৃত্তি করার সাহস না পায়।

“নিরপেক্ষ লোক দিয়ে তদন্ত করে প্রকৃত অপরাধীদের বের করতে হবে। যাতে কোনো পক্ষপাতিত্ব না হয়” বলেন তিনি। তবে দলের ৩ নেতাকে সাময়িক বহিষ্কার ও তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও এ ঘটনায় জেলা কমিটির কোনো মিটিং এখনো হয়নি বলে জানিয়েছেন তিনি।

তাজুল ইসলাম বলেন, কেউ বিষয়টি ড্রিল করছে না, যার যার মত কথা বলছে; এটা যথাযথ না। উচিত হবে বিষয়টি কঠোরভাবে দেখা। তদন্ত করে অপরাধী যে কেউ হোক, যে দলেরই হোক তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। কারণ মেজরিটি, মাইনরিটির বিষয় না এটা; নাগরিক হিসেবে সবাই সমান। মাইনরিটি বলে তাদের দুর্বল করে দেওয়া হচ্ছে। এরা এদেশের নাগরিক, তারা এ ধরনের ঘটনার শিকার হবেন এটা গ্রহণযোগ্য না।

উল্লেখ্য, গত ৩০ অক্টোবর ফেসবুকে ইসলাম অবমাননার অভিযোগ তুলে নাসিরনগরে ১৫টি মন্দির ও হিন্দু সম্প্রদায়ের দেড় শতাধিক ঘরে ভাংচুর ও লুটপাট চালানো হয়। পরে শুক্রবার ভোরে উপজেলা শহরের মধ্যপাড়া ও দক্ষিণপাড়ায় হিন্দুদের কয়েকটি বাড়ি ও মন্দিরে আগুন দেওয়া হয়।

এরপর সহস্রাধিক লোককে আসামি করে দুটি মামলার পাশাপাশি তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এছাড়া গাফিলতির অভিযোগে নাসিরনগর থানার ওসি আবদুল কাদেরকে বুধবার প্রত্যাহার করা হয়।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button