স্বাধীনতার ইতিহাস ও প্রজন্ম ভাবনা
ইতিহাস চলে তার নিজস্ব গতিতে। কোনো ছক বা প্যাটার্ন ইতিহাস মানে না। যদিও সাময়িকভাবে ইতিহাসকে একটি ছকের মধ্যে আবদ্ধ বা বিকৃত করা যায়, কিন্তু সময় সাপেক্ষে স্বীয় মহিমায় সে উদিত হবে। ইতিহাস ধ্বংস হয় না, পাথর চাপা ঘাসের মতো একদিন সে বেড়ে উঠবেই। ইতিহাস ইতিহাসই। একটি জাতি বা প্রজন্মের জন্য ‘ইতিহাস’ খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যে কোনো জাতির পূর্ববর্তী ইতিহাস সে জাতির জন্য আলোকবর্তিকা বা পথপ্রদর্শক স্বরূপ। সে তার আগের ইতিহাস, কৃষ্টিকালচার, সংস্কৃতি দ্বারা অনুপ্রাণিত ও প্রভাবিত হয়। তাই প্রয়োজন, প্রত্যেক জাতিগোষ্ঠীর তাদের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে সঠিকভাবে ধারণ, পোষণ ও লালণ করা। যাতে করে তাদের নতুন প্রজন্ম একটি স্বচ্ছ ও অবিকৃত ইতিহাস জানতে পারে।
বহু বছর আগে থেকে অর্থাৎ পাল-সেন যুগ থেকে শুরু করে সুলতানি, মোগল সর্বশেষ ব্রিটিশ-পাকিস্তানি আমলের মধ্যে হাজার-দেড় হাজার বছরের এ অঞ্চলের মানুষের বৈপ্লবিক অর্জনগুলোর মধ্যে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভ করাই হলো সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন। মূলত এ বাংলা ভূখ-ের মানুষ পাল রাজত্বের পর থেকে স্বশাসিত ছিল না। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী ও উপনিবেশবাদী দ্বারা শাসিত ছিল। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তানিদের পরাজিত করে স্বাধীনতা অর্জনই হলো বিশুদ্ধ স্বাধীনতা। পৃথিবীতে কোনো জাতিই এতো কম সময়ে স্বাধীনতা অর্জন করতে সক্ষম হয়নি। যারা সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল তারাই জানে নয় মাসের মধ্যে শেষ হওয়া যুদ্ধটা ছিল কত ভয়াবহ। কতো বিশাল আত্মত্যাগ করে স্বাধীনতা অর্জন করতে হয়েছিল। তৎকালীন এদেশের তরুণসমাজ দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ না হয়ে যদি পাওয়া না পাওয়ার হিসাব কষতে বসত, তাহলে এতো তাড়াতাড়ি দেশটাকে পাওয়া যেতো না। আমাদের সৌভাগ্য এদেশের তরুণসমাজ বেহিসেবি আবেগে দেশের জন্যে ভালোবাসায় অকাতরে প্রাণ বিলিয়ে দিয়ে দেশটাকে স্বাধীন করেছিল। তাই এই মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখতে হবে। প্রতিটি বাঙালির ঘরে ঘরে এই ইতিহাসকে ধারণ করতে হবে কিন্তু যাদের ত্যাগ-তিতিক্ষায় ও আত্মদানের মাধ্যমে স্বাধীনতা পেলাম আমরা কি সত্যি সত্যিই পারছি তাদের সঠিক ইতিহাস ধরে রাখতে?
স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরও মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস নিয়ে নতুন প্রজন্ম বিভ্রান্ত হচ্ছে। সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের স্থায়িত্ব নির্ভর করে। অর্থাৎ সরকার পরিবর্তন হলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের মৌলিক পরিবর্তন ঘটে, যা প্রতিফলিত হয় বিভিন্ন পাঠ্যপুস্তক ও ইতিহাস গ্রন্থে। যার ফলে তরুণ শিক্ষার্থীরা সময়ের ব্যবধানে ব্যতিক্রম ইতিহাস আয়ত্ত করছে। নতুন প্রজন্ম এবং শিক্ষার্থী পাঠ্যপুস্তকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পড়তে গিয়ে কখনো শিখেছে স্বাধীনতার ঘোষক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, কখনো শিখেছে জিয়াউর রহমান, যা একটি প্রজন্মের জন্য খুবই দুর্ভাগ্যের। এভাবে গত দুই দশক ধরে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের ক্ষমতার পালাবদলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পরিবর্তন হয়েছে। এটা সকল মানুষের কাছে একটি পরিষ্কার বিষয়। সর্বশেষ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশ সংবিধানে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ রাতে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। পাঠ্যপুস্তকেও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নতুন সংযোজিত হয়েছে। সপ্তম শ্রেণির ‘বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়’ পাঠ্য বইয়ে ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতার পটভূমি’ পাঠে ‘৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে গ্রেফতারের আগে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। এতে সময়ের উল্লেখ নেই। কিন্তু বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত ও পাঠ্য বইয়ের ইতিহাসে এবং সংবিধানে উলি্লখিত স্বাধীনতার ঘোষণার সময়ের মধ্যে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রকাশিত, ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী রাত ১০ ঘটিকার আগে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে। এর আগে তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে সংক্ষিপ্ত প্রেস ব্রিফিং করেন। পরের দিন ২৬ মার্চ দৈনিক ইত্তেফাকে ছাপা হয়, ‘২৭ মার্চ সারাদেশে ধর্মঘট-বঙ্গবন্ধু’। তাই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সরকারের পর্যায়ক্রমে সংশোধন ও যোজন-বিয়োজনে এমন কোনো অংশ অন্তর্ভুক্ত করা উচিত হবে না যার দ্বারা বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। কারণ মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন বাস্তবচিত্র, প্রিন্ট, ইলেক্ট্রনিঙ্ মিডিয়ার তথ্যচিত্র, প্রত্যক্ষদর্শী, সেক্টর কমান্ডার, বীর মুক্তিযোদ্ধারা মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস ধারণ করে এখনো বর্তমান আছেন। তাদের সমন্বয়ে, অরাজনৈতিক চিন্তা-চেতনায় নির্দলীয় কমিশন গঠন করে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস প্রণয়ন করা সম্ভব। যে ইতিহাস সরকার পরিবর্তন হলে পরিবর্তিত হবে না। যে ইতিহাসে স্বাধীনতা সংগ্রামে অবদানকারী রাজনৈতিক নেতারাসহ স্বাধীনতা সংগ্রামের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মুক্তিযুদ্ধের বিশেষ ভূমিকা পালনকারী শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান, মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানী, সেক্টর কমান্ডাররা, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীসহ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানকে ছোট করে দেখা হবে না। সে ইতিহাস হবে সার্বজনীন। নতুন প্রজন্ম ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে নব-উদ্যোগে সামনের দিকে এগিয়ে যাবে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
আমরা বর্তমান প্রজন্ম দেখিনি মুক্তিযুদ্ধ। তারপরও ‘৭১-এর সেই ভয়াল দিনগুলোর কথা শুনলে রক্ত গরম হয়ে যায়। মনে হয় কেন ‘৭১-এ জন্ম নিলাম না। দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধে বহু ত্যাগের বিনিময়ে বিজয়ের সূর্য ছিনিয়ে আনে বাঙালিরা। এদেশের তরুণ সমাজ যারা দেশকে ভালোবাসে, যারা দেশকে গড়ে তুলতে চায়, তাদেরকে যদি সঠিক পথ দেখিয়ে দেয়া যায়, তাহলে তারা অবশ্যই আমাদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হবে। যে চেতনা ও স্বপ্ন নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে দেশটাকে হানাদার মুক্ত করেছিল তার প্রতিফলন ঘটবে।