বিশ্বকাপ ফুটবল ও বাঙালীর পাগলামী_সফিউল্লাহ আনসারী
চলছে বিশ্বকাপ ফুলবলের সবচেয়ে বড় আসর ফিফা ওর্য়াল্ডকাপ-২০১৮। বিশ্বজুড়েই ফুটবল উন্মাদনা। পৃথীবির সকল দেশেই ফুটবল জ্বরে ভোগছে ফুটবলপ্রেমী। আমাদের বাংলাদেশ এর ব্যাতিক্রম নয়। দেশের আনাচে-কানাচে,দোকান,হাট-বাজার,স্কুল-কলেজ-ভার্সিটি, ঘরে-অন্দরে সর্বত্রই বিশ্বকাপ ফুটবল উন্মাদনা। নিজের পছন্দের দলকে সার্পোট করে কেউবা বাজি ধরতেও দ্বীধা করছে না। সারা দেশে সর্মথকদের প্রিয় দলের পতাকায় ছেয়ে গেছে পাড়া-মহল্লা, সড়ক-মহাসড়ক,বাড়ীর ছাদ এমনকি গাড়ীতেও উড়ছে প্রিয় দলের পতাকা।
বাঙালী মানেই ফুটবল প্রেমী। এদেশের মানুষ ফুটবল পাগল। বিশ্বকাপ ফুটবলে আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল ছাড়াও ¯েপন, জার্মানী, ইটালি, ইংল্যান্ডের সমর্থকদের উন্মাদনা শহর-গ্রামে সমানতালে উৎসবের আমেজ ছড়িয়েছে। প্রিয় দলের পতাকা,জার্সি, আর পাড়া-মহল্লায় ছোটখাটো আয়োজনে চলছে জমজমাট ফুটবল প্রতিযোগীতাও। প্রিয় দলের খেলার তারিখে বিশাল প্যান্ডেলে বড় পর্দায় খেলা দেখার বিশাল আয়োজনে খাবার-দাবারের ব্যাবস্থা চোখে পড়ার মতোই। সারা রাত জেগে খেলা দেখার উন্মাদনা ফুটবল ছাড়া যেনো অসম্ভব। দেশজুরে ব্রাজিল আর্জেন্টিনা সমর্থকদেও বাড়াবাড়িতে ঘটছে মারামারির ঘটনা। অতিরিক্ত পাগলামীতে নিজের দল হেরে যাওয়ায় আত্মহত্যার ঘটনা আমরা পত্রিকায় পড়ছি। বিশ্বকাপকে ঘিরে দেশের বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠছে ফ্যান ক্লাব, সর্মথক গোষ্টি, যার ব্যানারে মোটর শোভাযাত্রাসহ নানা আয়োজন বাঙালীর ফুটবল প্রেমীরই পরিচয় বহন করে।
অনেক এলাকায় নিজের বাড়ি, প্রতিষ্ঠান প্রিয় দলের সমর্থনে রঙ দিয়ে সজ্জিত করা হয়েছে। কোন কোন ক্ষেত্রে অতিরিক্ত বাড়াবাড়িতে অঘটন আমাদের আনন্দের সাথে বেদনাকেও বাড়ায়। তবে চলতি বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে সবচেয়ে বেশী মাতামাতি ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে । নিজের সর্মথিত দেশ ও দল এবং প্রিয় খেলোয়ার নিয়ে বাকযুদ্ধ, বিভিন্ন সময়ে ওসব দেশের খেলার চমকে দেয়া বিভিন্ন তথ্য দিয়ে হেনস্থাসহ নানা ধরনের অসুস্থ প্রতিযোগীতও চলে অথচ এসব কিছুই সর্মথন প্রাপ্ত দেশ বা দেশের খেলোয়ারা জানেন না। আর মেসি-নেইমার আর রোনাল্ডোর তা জানার প্রশ্নই আসেনা অথচ এদের নিয়ে কতোই না মাতামাতি! তবে এসবে পেছনে একটিই কারন বাঙালীরা ফুটবল নিয়ে পাগলামী। ফুটবলে পাগলামী থাকলেও ক্রিকেট তাদের অস্বিত্ব।
এক সময় বাংলাদেশে জমজমাট খেলার আসর মানেই ছিলো ফুটবল। আর বাঙালী ফুটবলপ্রেমী হিসেবে বেশ উৎসব মুখর। বিশ্বকাপ খেলা চলাকালীন সরগরম থাকলেও সময়ের পরিবর্তন আর বিশ্ব ক্রিকেটের দাপটে এখন সে অবস্থা আর নেই বললেই চলে। শুধু শহর নয় গ্রাম-গঞ্জের ছোট-বড় পাড়া মহল্লায়ও আজ ক্রিকেট উন্মাদনা, অথচ ফুটবলই ছিলো ওদের পায়ে পায়ে। আস্তে আস্তে যেনো ক্রিকেটের দাপটে ভুলেই যাচ্ছে বাঙালী ফুটবল খেলাকে। শুধু বাংলাদেশ নয়, দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় দেশেই ক্রিকেটের রাজত্ব। তবে গর্বের বিষয় হচ্ছে দক্ষিন এশিয়া থেকে জাপান ও দ:কোরিয়ার বিশ্বকাপে খেলা। আরও গর্বের খবর চলতি বছর মেয়েদের ফুটবল খেলায় চ্যাম্পিয়ন হওয়া।
আমাদের গ্রামীন আয়োজনে ফুটবল খেলায় এখনও দর্শকের বিপুল সমারোহ আর অংশগ্রহন লক্ষ করা যায়। ফুটবলমোদীদের পদচারনায় ক্ষুদ্র আয়োজনও উচ্ছাসে বাধ ভাঙে। বিশ্বকাপে বিপুল উৎসাহি দর্শক পাওয়া গেলেও, দর্শক খরায় ভুগছে ফুটবল টুর্নামেন্ট । এমনটি প্রায়ই শোনা গেলেও দর্শক মাঠে টানতে উদ্যোগ খুব একটা চোখে পড়েনা !
ক্রিকেট খেলা খুব বেশী দিন আমাদের দেশে মাঠ দখল না করলেও আমাদের বাংলাদেশের পরিচয় বিশ্বের বুকে নতুন করে দিয়েছে এই খেলা। বাংলার দামাল ছেলেরা ফুটবলে খুব একটা নাম না করতে পারলেও ক্রিকেটে পেরেছে,এটা গর্বের-আনন্দের । ফুটবলের জনপ্রিয়তার ক্ষেত্র পরির্বতন করে আজ ক্রিকেটে বেড়েছে ক্রীড়ামোদীর জোক। তাই বলে ফুৃটবলকে ভুলে থাকলে চলবে না।
এক সময় দেশের আনাচে-কানাচে দেখা যেতো ছেলে-বুড়োর ফুটবল নিয়ে ব্যস্ততা । বর্ষা মৌসুম ছাড়া দেশে ফুটবল চর্চা নেই বললেই চলে। মনে হয় ফুটবল অনেকটা বানিজ্যিক বা সরকারী উদ্যোগে শহর কেন্দ্রিক গন্ডিবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। ব্যাপক চর্চা না থাকায় ফুটবলের মান নষ্ট হচ্ছে বাংলাদেশের ক্লাবগুলোতেও। এরকম কারনেও ফুটবল মাঠে দর্শক উপস্থিতি কম। আজকের প্রতিযোগীতার এই সময়ে শুধু ক্রিকেট নয়, ফুটবল নিয়েও আমাদেও ব্যাপক উদ্যোগী ও উৎসাহী হতে হবে।
শুধু যে ফুটবল তা নয়, আমাদের জাতীয় খেলা হা-ড-ুডুসহ দেশীয় প্রায় খেলার আজ বেহাল দশা। অন্য কারনেগুলোর সাথে রয়েছে ক্রিকেট উন্মাদনা। সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা, স্থানীয় বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রিক উৎসাহ ও আয়োজনে অনীহা, সামাজিক পরিবর্তনসহ বিভিন্ন কারন।
‘‘ ফুটবল খেলা কোন দেশে কখন প্রথম চালু হয় সে সম্বন্ধে ঐতিহাসিকরা একমত নন। কেউ বলেন চীন, কেউ গ্রিস, কেউ রোম, কেউবা ইংল্যান্ডকে ফুটবল খেলার আবিষ্কারক মনে করেন। তবে রোমানরাই ফুটবল খেলাকে ইউরোপের সঙ্গে প্রথম পরিচয় করিয়ে দেয় এবং এ খেলার বিস্তৃতি ও জনপ্রিয়তা দান করে। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে ফুটবল ইংল্যান্ডে প্রবেশ করার পর থেকে এর প্রচার, প্রসার ও জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। ১৮৪৮ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা প্রথম ফুটবলের জন্য আইন-কানুন প্রণয়ন করে। পরবর্তীকালে এর আরও পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও পরিমার্জন ঘটে এবং ফুটবলের জন্য একটি পরিপূর্ণ নীতিমালা তৈরি হয়। তাই ইংল্যান্ডকে আধুনিক ফুটবলের জনক বলা হয়। তারাই ফুটবলকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেয় এবং জনপ্রিয় করে তোলে। ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে পৃথিবীতে ফুটবলের জনপ্রিয়তা বাড়ে। ১৯০৪ সালের ২১ মে প্যারিসে ইউরোপের ৭টি দেশের প্রতিনিধিদের বৈঠকে ফেডারেশন ইন্টারন্যাশনাল দ্য ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন (ফিফা) গঠিত হয়। ১৯৩০ সালে আয়োজন করা হয় বিশ্বকাপ ফুটবলের। উরুগুয়ে প্রথম বিশ্বকাপের শিরোপা জয় করে।’’
খেলাধুলা মানুষের শরীর ও মন দুটোকেই উজ্জীবিত রাখে, রাখে উৎফুল্ল। কিন্ত বর্তমানে মাঠ নির্ভরতা কমে খেলা এখন গেম নামে মোবাইল, ক¤িপউটার আর ইন্টারনেটে বন্ধি হয়ে যাচ্ছে। যদি আশা জাগিয়ে রাখছে ক্রিকেট খেলা । শুধু দেশের মাঠ নয় বিদেশেও আমাদের টাইগাররা জয়ের ধারাবাহীকতায় বয়ে আনছে গর্ব করার মতো সুনাম। আমরা ফুটবল পাগল জাতী হিসেবে ক্রিকেটের সুনামের পাশাপাশি ফুটবল খেলায়ও বিশ্বের মাঝে সুনাম বয়ে আনতে চেষ্টা চালাতে হবে। শুধু কথায় নয় কাজে প্রমাণ রেখে ফুটবলের সোনালী দিন ফিরিয়ে আনা সময়ে অনিবার্য দাবী।
ক্রিকেটের পাশাপাশি সর্বসাধারণের প্রিয় খেলা, বিশ্বের জনপ্রিয় খেলা ফুটবলকেও বাঁচিয়ে রাখতে সরকারের পাশাপাশি সামাজিক ও ব্যাক্তিগত উদ্যোগ গ্রহন করা প্রয়োজন। শুধু বাফুফে নয় ফুটবলকে উজ্জীবিত রাখতে আমাদের স্কুল-কলেজে সেই আগের মতো আয়োজন অব্যহত রাখা দরকার। ফুটবলের সোনালী দিন ফিরিয়ে আনতে আমাদের শুধু বিশ্বকাপ উন্মাদনায়ই নয় বছরজুড়ে এই খেলার প্রতি টান, ভালোবাসা ও আন্তরিকতা নিয়ে চেষ্টা চালাতে হবে। আমরা চাই বিশ্বকাপে ভিনদেশী দল আর খেলোয়ার নয় আমাদের বাংলাদেশ ও আমাদের খেলোয়ারদের নিয়ে আমরা মাতামাতি করবো। আমার দেশে শুধুই পতাকা উড়বে লাল সবুজের, অন্য দেশের না। জয় হোক ফুটবলের, জয় হোক বাংলাদেশের।
(তথ্য: অনলাইন/ বাংলাপিডিয়া)