উপ-সম্পাদকীয়মতামতসমকালীন কলাম

বাংলা ভাষার বই; পাঠ অভ্যাসে প্রজন্ম

আবুল বাশার শেখ

বছর ঘুরে আবার শুরু হলো শোক শক্তি আর গর্বের মাস, ভাষার অধিকার আদায়ের মাস ফেব্রুয়ারি। ‘মোদের গরব মোদের আশা, আমরি বাংলা ভাষা’ এই প্রিয় বাংলা ভাষা বাংলাদেশের বাঙালী জাতির প্রাণের সাথে মিশে আছে। এ মাসটির সঙ্গে মিশে রয়েছে বাঙালির কৃষ্টি সংস্কৃতি ঐতিহ্য আর বীরত্ব গাঁথা। ইতিহাস শিক্ষা দেয় একমাত্র বাঙালি জাতি ছাড়া পৃথিবীর কোনো জাতি ভাষার জন্য প্রাণ দেয়নি। তাই এই ভাষার গুরুত্ব সারা বিশ্বের সেরা।

সারা ফেব্রুয়ারি মাসে মাথার ওপরে বাংলা অক্ষরের এক অনন্ত আকাশ ঝুলে থাকে। কোটি কোটি বাংলা বর্ণমালা সেই আকাশে সমুজ্জ্বল। বাঙালির এ এক অসামান্য উৎসব, অসামান্য মিলনমেলা। অমর একুশে বইমেলা বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম একটি অনুষঙ্গ, ঐতিহ্যেরও পরিচায়ক। বইমেলা মানেই পাঠক-লেখক-প্রকাশকের মিলন ক্ষেত্র। বইমেলা মানেই নতুন বইয়ের কাঁচাগন্ধ।

ভাষার মাস ও একুশের কথা বলতে গেলে মাতৃভাষার প্রতি অবজ্ঞা, উপেক্ষা এবং নৈরাজ্যের বিষয়টিই বার বার সামনে চলে আসে। শুধু একুশ আসলেই বাংলা ভাষার চর্চায় আমরা খাটি বাঙালী বনে যায়। কিন্তু সারা বছর এই বাংলা ভাষায় রচিত বইগুলো থাকে অবহেলিত। এর পরিবর্তন হওয়া অবশ্যই জরুরি দাড়িয়েছে। আমাদের প্রিয় বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করতে চাইলে বই পড়ার কোন বিকল্প নাই।

২০ শতকে বাঙালি ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছে, বাংলা বর্ণমালা রক্ষার জন্য সংগ্রাম করেছে, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছে, একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসরূপে স্বীকৃতি পেয়েছে এসব বাঙালির অনন্য অর্জন। অনেক আগে থেকেই কিছু স্বার্থান্বেষী মহল বাঙালির এই অনন্য আয়োজনকে নস্যাৎ করার ষড়যন্ত্র করে আসছে, জাতিসত্তা ও জাতিরাষ্ট্র বিপন্ন করে তোলার অপচেষ্টা করছে। তাদের এহেন কর্মকান্ড কোন ভাবেই মেনে নেয়া যায় না। বাংলা ভাষাকে সমুন্নত রাখতে বুদ্ধিমত্তার সাথে এগিয়ে যেতে হবে। বাংলা ভাষাকে সর্বজনিন ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। ভাষাকে সমৃদ্ধ করতে চাইলে বাংলা ভাষার চর্চা আরোও বৃদ্ধি করতে হবে। বাড়াতে হবে বাংলা ভাষার পাঠক সংখ্যা।

সেই কবে প্রমথবাবু বই পড়া নিয়ে বাঙ্গালি জাতিকে জ্ঞানগর্ভ লেকচার ঝেড়েছিলেন, বলাই বাহুল্য, তাঁর এই প্রয়াস মোটামুটি অরণ্য রোদনেই পর্যবসিত হয়েছিল, হাজার হলেও চোরকে ধর্মের কাহিনী বলে তো আর ফায়দা নেই। তবে প্রমথবাবুর সৌভাগ্যই বলতে হবে, বহুকাল আগেই তিনি আধুনিক সভ্যতার মায়া ত্যাগ করে গত হয়েছিলেন, নইলে এই ঘোর কলিকালে বইপড়া যে রীতিমত জাদুঘরে শোভা পাবে, এমনটা বোধহয় তিনিও কস্মিনকালেও ভাবতে পারেননি। বই পড়াকে তিনি বলেছিলেন বিলাসিতা, কিন্তু ওই বিলাসিতাটুকুও মানুষ ওই সময় হরদম করত (সে মুরোদও তাদের ছিল বৈকি) আর এখন! যাদের পক্ষে ওই বিলাসিতাটুকু করা সম্ভব তাদের জন্যও এটা চাচা ঢাকা অনেক দূর বটে। আর হতভাগা বইগুলো সব বৈঠকখানার শোভাবর্ধনই করছে, সেখান থেকে তাদের যে পরিত্রাণ দেবে, এমন জ্ঞানপিপাসুর সংখ্যাও আজকাল জ্যামিতিক হারে হ্রাস পাচ্ছে।

খুব বেশিদিন আগের কথা নয়, আমার শৈশব-কৈশরের সোনায় মোড়ানো সময়টুকুতে রীতিমত নাওয়া খাওয়া ছেড়ে গোগ্রাসে বই গিলতাম। নতুন বইয়ের ঘ্রাণের ছিল আলাদা এক মাদকতা, যার জন্য অধীর হয়ে থাকতাম। এখনো মনে পড়ে ক্লাস নাইনে স্কুল থেকে পুরষ্কার পাওয়া বইগুলোর কথা, প্রয়াত হুমায়ুন আহমেদ স্যারের লেখা নন্দিত নরক একদিনে নাওয়া খাওয়া ভুলে গিয়ে শেষ করেছিলাম।

এরপর স্কুল কলেজের গন্ডি ছাড়ানোর পর্যন্ত মোটামুটি বইপোকাই ছিলাম, বইপড়া শুধু শখই ছিলনা, ছিল নেশা। মাঝে মাঝে এই নেশায় ভাটা পড়লেও তেমন কোন খরা কখনো আসেনি। কিন্তু এখন! আমজনতাকেই দোষ দেই কি করে, নিজেরই বই পড়ার হার মোটামুটি আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে। তবে একটা কথা বোধহয় বলাটা অসমীচীন হবেনা, বই পড়ার এই খরাটুকু এখন বোধহয় হাল জমানার শিশু কিশোরদের মাঝেও সংক্রামিত হয়েছে।

প্রতিযোগীতার যুগে পাল্লা দিয়ে দৌড়ানোর জন্য অ্যাকাডেমিক চাপ বা উচ্চাভিলাষী অভিভাবকদের আরোপিত “এক্সটা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিজ” বা কম্পিউটার গেমসের প্রতি ডিজিটাল নেশার টান অথবা “খোমাবই” এর মত কিছু সামাজিক যোগাযোগ সাইটে তাদের যথেচ্ছ বিচরণ; যে কারণগুলোই এজন্য দায়ী হোক না কেন, বই পড়ার দিকে তাদের আপাত ঔদাসীন্য যে আখেরে কোন ভাল ফল বয়ে আনবেনা, সেটা বোধহয় আর নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই।

বিশেষ করে যেসব শিশু সুকুমারের আবোল-তাবোল, হ-য-ব-র-ল বা পাগলা দাশুর মত বই পড়া থেকে বঞ্চিত, তাদের জন্য যুগপত আফসোস্ ও আশঙ্কা হয় বৈকি। আজকের দিনেই যারা এসব মনি মুক্তো আহরণ করতে পারলনা, আগামী দিনে তাদের নিয়ে “ডিজিটাল বাংলাদেশ” গড়ারই স্বপ্ন দেখা যেতে পারে, এর বেশি কিছু নয়। আমাদের আধুনিক অভিভাবকদের এই কথাটিও বুঝতে হবে যে বিশ্বটাকে জানতে হলে পড়ার কোন বিকল্প নেই।

তাই স্কুল কলেজের পাঠ্য বইয়ের সাথে সাথে অল্প করে হলেও বাহিরের বইগুলো পড়তে হবে। আমাদের নতুন প্রজন্মকে বাংলা ভাষার গুরুত্ব বুঝাতে হবে সে সাথে তাদেরকে বাংলা ভাষায় রচিত গ্রন্থগুলো বেশি বেশি পড়ার জন্য উৎসাহিত করতে হবে। আর মেলা শেষ হলেই যে বাংলা বইগুলোর কদর কমে যায় এই ধ্যান ধারণা ভুলে যেতে হবে। তবেই এই বইগুলো অবহেলার হাত থেকে রক্ষা পাবে সে সাথে রক্ষা পাবে বাংলা ভাষাও। বৃদ্ধি পাবে বাংলা ভাষায় রচিত বইগুলোর পাঠক পাঠিকা।

আবুল বাশার শেখ
কবি, গল্পকার, সংবাদকর্মী
দপ্তর সম্পাদক, ভালুকা প্রেসক্লাব
ভালুকা, ময়মনসিংহ।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button